সিরাজগঞ্জের ভাষাসংগ্রামীদের জীবনীপাঠ উপস্থাপন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম মাহবুবুল হক পাঠাগারের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১ মার্চ ছিল একটি আলোচনা অনুষ্ঠান। পাঠাগারের উদ্যোগে সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাবের তৃতীয় তলায় জীবনীপাঠে অংশ নেওয়া স্কুল-কলেজের ২৮ শিক্ষার্থীর সবাইকে পুরস্কৃত করা হয় বই দিয়ে। অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তা কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে ছুটির সকালে রাজধানী থেকে বের হই যমুনা পাড়ের শহরের উদ্দেশে। জ্যামের বিরক্তি মিলিয়ে যায় যমুনা সেতু পেরিয়েই পথের দুই পাশে পলাশের সমারোহে। তা পূর্ণতা পেয়ে প্রাণে নতুন স্ফুরণ ও স্পন্দন আনে মিলনায়তনে নানান বয়সি শতাধিক দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে।
তরুণ তুর্কিদের বইয়ের জগতে নিয়ে আসার উদ্যোগ থেকেই তিন বছর আগে ইসমাইল হোসেন (স্থানীয় একটি দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদক) রাজনৈতিক সহযাত্রীদের নিয়ে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের উচ্ছল সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতেই তাদের এ উন্মাদনা। আজ যখন আমরা মুঠোফোন, স্যাটেলাইট আর বোকাবাক্সের খপ্পরে বন্দি, তখন ইসমাইল হোসেন তার কর্মোদ্দীপনার মাধ্যমে নিজের খেয়েই তাড়িয়ে চলেছেন বনের মহিষ। আমরা যখন সমাজমাধ্যমের সুবিধা নিয়ে একে অন্যের কাছে আসার কথা বলছি, যা প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ঘরের বাইরে, অদেখা-অচেনা মানুষের কাছে। যার সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক নেই। রয়েছে এক অলীক অস্তিত্ব। অথচ সেই অলীকের হাতছানি উপেক্ষা করার সাহসও আমাদের নেই। একে এড়ানোর ক্ষমতাও আমরা ক্রমে হারাচ্ছি। ফলে ঘরের মানুষ হয়ে উঠছে পর, দূরের মানুষ হয়ে উঠছে আপন। আবার সেই আপন মানুষটিই যখন পাশে দাঁড়াচ্ছে, তখন আমরা আরও আপন কোনো মানুষের খোঁজে ব্যস্ত। ফলে ফাঁপা, মেকি সম্পর্কের যে আস্তরণের মাধ্যমে হৃদয়ে হৃদয় বাঁধার স্বপ্ন দেখছি, তা কোনো বন্ধনই তৈরি করছে না।
এ রকম চরম সত্যের মুখে দাঁড়িয়েও যখন কেউ স্বপ্ন দেখাতে চান, সম্পর্কের সুতো দিয়ে মালা গাঁথতে চান তখন তাকে শুধু ধন্যবাদ বলা কম হয়। ইসমাইল হোসেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম মাহবুবুল হক পাঠাগার সেই স্বপ্নেরই সেতু বানাতে চাইছে, প্রাণে প্রাণ মেলাতে চাইছে, যাতে কাগজের গন্ধমাখা শক্ত মলাটের দিকে মানুষ চোখ ফেরায়। বায়বীয় অলীক স্বপ্নের দুনিয়া থেকে ফিরে সাদা কাগজে কালো অক্ষরে ফুটে ওঠা বর্ণমালাকে ভালোবাসতে শেখে। সেই সঙ্গে হয়ে ওঠে ইতিহাসসচেতন। যেখানে শুধু জাতীয় পর্যায়েরই নয়, স্থানীয় পর্যায়ের ইতিহাস ও সত্যেরও সন্ধান করে।
২.
জেলা শহরগুলোয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমেছে। মানুষকে একত্র করার প্রয়াস খুব কমই চোখে পড়ে। সংবাদপত্রেও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের খবর কম আসে। যেন সমাজের বড় অংশের মানুষ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। অনেক বেশি যান্ত্রিকতার মাঝে সুপ্ত প্রতিভা ও সুকুমার বৃত্তিগুলোর খবরও এখন অনেকাংশেই অজানা। অথচ এই সেদিনও, পেছন ফিরে তাকালেই দেখতে পাই গ্রামে গ্রামে নাটক হতো, পালাগান হতো, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ঘিরে রাখত শিশু-কিশোরদের। এই সেদিনও নানা নামে পাড়ামহল্লায় ক্লাব ছিল। তাদের আয়োজনে জড়িয়ে থাকত আবেগ, ভালোবাসা। এসব ক্লাবের উদ্যোগে শুধু নাটকের প্রদর্শনীই নয়, বের হতো দেয়ালপত্রিকাও। ঈদ, পহেলা বৈশাখ আর জাতীয় দিবস তো বটেই, যেকোনো উৎসব-পার্বণেও ঢল নামত দেয়ালপত্রিকা প্রকাশের। যার হাতের লেখা ভালো তার কদর বেড়ে যেত এ সময়। এলাকার আলোচিতদের ‘খেতাব’ দেওয়া হতো বাংলা এবং গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উপলক্ষে। খেতাবের সেই ভাষায় মিশে থাকত পাড়ামহল্লার দুষ্টু ছেলেদের বুদ্ধির দীপ্তি। খেতাব শুধু তরুণ-তরুণীরাই নয়, এলাকার আলোচিত মুরুব্বিরাও পেতেন। খেতাবের মাঝে যেমন থাকত ব্যঙ্গবিদ্রূপ, তেমন ভালোবাসারও প্রকাশ। তবে কখনোই সীমা ছাড়াত না। কে কী খেতাব পেল, তা নিয়েও আলোচনা চলত। খেতাব পছন্দ না হলে, চেষ্টা করা হতো গোপনে খেতাব ঝোলানো কাগজটি ছিঁড়ে ফেলার। কিন্তু বড় বিরোধ হতো না। একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হতো না। কথায় কথায় একে অন্যকে রক্তাক্ত করার চলও তখন চালু হয়নি।
শিশু-কিশোরদের উৎসাহ দেওয়া হতো ছবি আঁকায়। কুইজ প্রতিযোগিতাও থাকত। বাবা-মায়েরা গোপনে শিশুদের সহায়তাও করতেন, তবে তা-ও ছিল আনন্দের। কারণ কুইজে অনেক সময় এমন কঠিন প্রশ্ন হাজির করা হতো, যা মূলত রাখা হতো বাবা-মায়েদের পরীক্ষার জন্যই। এলাকার মা-চাচি-খালাদের জন্যও থাকত বালিশখেলা, চেয়ারখেলা। বাবা-চাচারা কখনও হাঁড়িভাঙা, কখনও হাঁস ধরায় অংশ নিয়ে ছেলেছোকরাদের বিনোদন দিতেন। চলত বই পড়া প্রতিযোগিতাও। এর সবই যেন আজ ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
৩.
গ্রাম-পাড়ামহল্লায় নানা নামে গড়ে ওঠা ক্লাবগুলোর মাধ্যমে সংগঠিত তরুণরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা খেলাধুলা ছাড়াও জনসেবা ও সামাজিক কাজে অংশ নিত। যে-কারও বিপদে তরুণরাই প্রথম এগিয়ে আসত। তারা কোনো বিনিময়ের আশা না করেই এলাকায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাত। দলবেঁধে তরুণদের ডোবা-নালা-খালের কচুরিপানা পরিষ্কারের দৃশ্যের খানিকটা প্রবীণদের চোখে এখনও লেগে আছে। অসুস্থকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া, খোঁজখবর রাখা, গ্রাম-পাড়ামহল্লায় যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেও তরুণরাই প্রথম প্রতিবাদের কণ্ঠ তুলেছে। তখন তারা কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সংগঠিত হয়নি, কিন্তু ছিল ভীষণভাবে রাজনীতিসচেতন। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি না করেও তাদের সচেতনতা, পরিমিতিবোধ সমাজকে সুস্থ রাখতে ভূমিকা রেখেছে। আজ সেখানেই যেন বিশাল শূন্যতা। আজকের তরুণরা আরও বেশি সংগঠিত, আরও বেশি সচেতন। তবে সেই সংগঠিত এবং সচেতনতার মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। সেই সঙ্গে আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো হঠাৎই সব পেয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও আমাদের মাঝে প্রবল। চটজলদি সাফল্য পাওয়ার স্বপ্ন ও ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠছে।
সাফল্যের জন্য সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওপরে উঠতে হয়, এ কষ্ট আমরা কেউই করতে আগ্রহী নই। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিল্পসাহিত্য সবখানেই দ্রুত পেতে চাই। মাঠে নামার আগেই শুনতে চাই সাফল্যের গল্প, যা একদিকে আমাদের পরিশ্রমবিমুখ, অন্যদিকে মেকি-ফাঁপা সাফল্যের দিকে প্রলুব্ধ করছে। ডেকে আনছে ভয়ানক সামাজিক ব্যাধি। সেখানে বড় হয়ে উঠছে অনেকের মাঝে থেকেও আমাদের একা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এর বিরুদ্ধে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কিশোর-তরুণদের যত বেশি সম্পৃক্ত করা যাবে ততই মঙ্গল। আর এ মঙ্গলকে আহ্বানের জন্য ইসমাইল হোসেন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম মাহবুবুল হক পাঠাগারের মতো উদ্যোগের পাশে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। কীভাবে দাঁড়াব সে সিদ্ধান্ত কঠিন নয়, শুধু নির্ণয় করতে হবে সমাজের স্বার্থপূরণে আমাদের অবস্থান।