সম্প্রতি রাজশাহী বিশ^দ্যিালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় ১ম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান নিয়ে স্রাতকোত্তর সম্পন্ন করলেন গণমাধ্যম কর্মী ইসমাইল হোসেন। এর আগে তিনি রাষ্টবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা ষাটোর্ধ্ব ইসমাইল হোসেন জন্ম নেন ১৯৫৯ সালের ইংরেজি নববর্ষের ১ তারিখে সিরাজগঞ্জ শহর নিকটবর্তী খোকশাবাড়ী ইউনিয়নে গুনেরগাতী গ্রামে মাতুলালয়ে। মাতা- বিখ্যাত রোকনী পরিবারের প্রয়াত আলহাজ ছকিনা খাতুন। বাবা প্রয়াত আলহাজ আব্দুল মজিদ খান। পিতা দীর্ঘ ৩৭ বছর ছিলেন সিরাজগঞ্জ পৌরসভার সচিব।
শৈশবে বেড়ে উঠেছেন সিরাজগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী পিতার পিতৃভুমি তেলকুপি গ্রামে। তিন বছর বয়স থেকে শহরের চৌরাস্তায় পিতৃালয়ে বসতি। শিক্ষা জীবনের শুরু স্থানীয় হৈমবালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এবিদ্যালয়ে পড়েছেন ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত। ৪র্থ শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন শহরের ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি। এশহর থেকেই স্লাতক ডিগ্রি নিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার বিভাগে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমাতে । সে সময় দেশে ছিল সামরিক শাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস এর চেয়ে সরব ছিলেন মিটিং মিছিলে। ছিলেন সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী শিক্ষা আন্দোলনের পুরোভাগে। ফলে ছেদ ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়। ৮৬ সালে রাজনৈতিক মতাদর্শে ছেড়ে দেন ছাত্ররাজনীতি। মনোযোগ দেন পড়াশোনায়। সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পুনরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় সম্পন্ন করেন দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর।
ছোট বেলায় ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে স্কোয়াড্রন লিডার মাহমুদুল আলম ( বীর আলম) এর যুদ্ধে পারদর্শিতায় প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন চৌকষ সৈনিক হিসেবে নিজেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এলক্ষ্যেই ভর্তি পরীক্ষা অংশগ্রহণ করেন রাজশাহী আইয়ুব ক্যাডেট কলেজে। কিন্ত ৭১ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ক্যাডেট কলেজে পড়া ছেদ ঘটে। স্বাধীনতার পর আর ওমুখো হননি।
৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে শহরের পৈত্রিকা বাসা পাকিস্তানিরা আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ৭১ এর মে মাসে শহরে ঢুকে নিজ চোখে দেখেন পিতার বাসাসহ গোটা শহরের বেশিরভাগ বাসা আগুনে ভস্মিভুত। দেখেন শহরের এখানে সেখানে বাঙালির মৃত দেহের হাড়হাড্ডি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস্থতা, নির্যাতন দেখে মনের ভিতর তীব্র ঘৃণা জন্ম নেয়। কিন্ত বয়সে ছিলেন কিশোর। সেকারণে যোগ দিতে পারেননি মুক্তিযুদ্ধে। এজন্য এখনও পীড়িত বোধ করেন।
রাজনৈতিক ভাবাদর্শে শৈশবে মওলানা ভাসানী পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসন ও শোসন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্বে প্রভাবিত হন। এভাবনা থেকেই সৈনিক জীবন নয় রাজনৈতিক নেতৃত্বই মানুষ ও মানুষের সমাজের পরিবর্তনের মুল ক্ষেত্র চেতনায় উজ্জীবিত হন। এসময় বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের হ্রদয়ে বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছিল সমাজতন্ত্রের ধারণা। পড়তে শুরু করেন লেনিনের রাশিয়া আর মাওয়ের চীন বিপ্লব। নিজেকে প্রস্তত করেন মেহনতী মানুষের মুক্তির সৈনিক হিসেবে। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে।
১৯৭২ সাল থেকে বিপ্লবের মোহে তৃণমুল যুক্ত হন একটি বাম ছাত্রসংগঠনে। ৮০ সালে কতিপয় সাম্প্রতিক বিতর্ক ও গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার বিতর্কে জাসদ ছেড়ে স্থানীয় পর্যায়ে বাসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখেন।
৮০ থেকে ৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, দফতর সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচালনা করেন ছাত্রসংগঠন। নেতৃত্ব দেন ৮৩ থেকে ৮৬ সাল পর্যন্ত সময়ে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে ডাকসুসহ ১৪ ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে। ৮৬ সাল থেকে আদর্শিক ও সাংগঠনিক প্রশ্নে মতবিরোধে নিজেকে সরিয়ে নেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে।
৯০ এর দশকে দর্শনগতভাবে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা থেকে সেভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপিয় দেশগুলো ফিরে আসে গণতান্ত্রিক ধারায় এবং গণচীনে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রায়োগিক পরিবর্তন ভাবিত করে তাকে। শেষ অবধি চিন্তাগতভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্নবী রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ভাবাদর্শগতভাবে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সমর্থক ইসমাইল হোসেন চিন্তায় চেতনায় স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমূলক বাংলাদেশ রাষ্ট্্েরর।
সাংবাদিকতার শুরু ১৯৭৮ সালে। তৃণমুলের পত্রিকা দিনাজপুরের উত্তরা পত্রিকার মধ্যদিয়ে যাত্রা হয় শুরু। পরে দৈনিক নিউ ন্যাশন পত্রিকার সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। ৮৫ সালে কিছুদিন সম্পাদনা করেন অধুনালুপ্ত ঢাকার সাপ্তাহিক খবরের কাগজে সাব এডিটর হিসেবে। পরে অধুনালূপ্ত বাংলার বাণীতে সাব এডিটর হিসেবে নিয়োগ পেলেও পেশাগত আর্থিক অনিশ্চয়তায় ছেদ পড়ে সাংবাদিকতায়।
এসময় ঢাকার ধানমন্ডিতে ডাকসু ভিপি আকতারুজ্জামানের সঙ্গে যৌথভারে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ-চায়না আকুপাংচার ইন্সটিটিউট। এছাড়াও তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা পরিবচালনা করেন প্রতিরক্ষা ক্রয় পরিদপ্তরে।
১৯৯৩ সালে স্ত্রী বিয়োগে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে সিরাজগঞ্জে ফিরে আসেন। বেঁচে থাকার জন্য পেশাগতভাবে যুক্ত হন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক, পদ্ম সেতু ভুমি অধিগ্রহনের সম্ভাবতা যাচাইয়ের সমন্বয়ক, ভৌরবে কাজী নজরুর ইসলাম সেতু, চট্রগ্রাম পোর্ট বাইবাস রোড, পদ্মা-মেঘনা রিভোর ইরোগেশন মিটিগেশন প্রজেক্ট, মিউনিপ্যাল সার্ভিস প্রজেক্ট, এলজিইডির নবিদেপ প্রজেক্টের আঞ্চলিক পুর্ণবাসন এক্সপার্ট হিসেবে। এরমাঝে প্রায় একদশক কাজ করেন এনডিপিতে।
চাকরির পাশাপাশি ২০১২ সাল থেকে স্থানীয় দৈনিক যুগের কথা পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক এর দায়িত্ব পালনশেষে বর্তমানে তিনি স্থানীয় দৈনিক সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি যুক্তিবান মানুষ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাব ভবনের দোতলায় পরিচালন া করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম মাহবুবুল হক পাঠাগার।
সাংবাদিকতায় পেশায় থাকাকালিন তিনি ১৯৮০ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ মহকুমা সাংবাদিক সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক এবং একই সময়ে তিনি সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব এর নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে সাংবাদিকদের সমস্যা নিয়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১২ সালে সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব এর পুনরায় সদস্য এবং ২০১৯-২০ কার্যকরি কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শেষে ২০১৯ সালে সমাপ্ত করেন দীর্ঘ ২৮ বছর পেশাগত জীবনের। স্থিতু হন নিজ শহর সিরাজগঞ্জে। বর্তমান সময়ে দায়িত্বপালন করছেন স্থানীয় দৈনিক সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। অবসরে বই পড়া ও লেখালেখিতে খুঁজে ফেরেন অতীত ঐতিহ্যকে। পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার উপযুক্ত চিন্তা চেতনায় মননশীল ও উন্নত রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার জন্য পরিচালনা করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম মাহবুবুল হক পাঠাগার। যুক্ত রয়েছেন সাংবাদিকদের পেশাগত ক্লাব সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাবে।
ব্যক্তিগত জীবনে ইসমাইল হোসেন এর পিতা-পুত্রের সংসার। একমাত্র সন্তান আসিফ নেওয়াজ দীপ্ত আইনে স্নাতকোত্তর।