এনডিপি প্রতিনিধি : বাসস্থান মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। খাদ্য ও বস্ত্রের পর মানুষের বড় প্রয়োজন আশ্রয়ের বা বাসস্থানের যা প্রতিটি মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। গৃহায়ন বলতে মানুষের বসবাসের জন্য নানা সুবিধাদি সম্বলিত বাস্তভূমির উন্নয়নকে বোঝানো হয়। জাতিসংঘের গৃহায়ন নীতিমালা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য গৃহায়ন ধারনাটি শুধুমাত্র বাসস্থানের ভৌত কাঠামোকে বোঝায় না, একই সাথে সকল ধরনের প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবারও উপস্থিতি আবশ্যক। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে মানববসতি বা আবাসনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন থেকে পরিবেশ, অর্থ ও সামাজিক চাহিদা এবং এর সাথে ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুগত বিষয়াবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গৃহের শৈলী ও ধরণ পরিবর্তিত হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে এবং বাকিরা ছোট-বড় শহরে বাস করে, যার মধ্যে ঢাকার মত সুবিশাল মেগাসিটিও রয়েছে। মানব জাতি যুগ যুগ ধরে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে আসছে এবং বংশ পরম্পরায় আবাসনে বিনিয়োগের সুফল ভোগ করে আসছে। আবাসন শুধু একান্তেই বসবাসের সুযোগ করে দেয়না বরং সুস্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ প্রদান করে কর্ম ও উপার্জনের ভিত্তি রচনা করতে সহায়তা প্রদান করে থাকে। এক কথায় আবাসন সামাজিক স্থিতশীলতায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানসময়ে আবাসন খাতকে পরিবারের সর্বোচ্চ একক বিনিয়োগ খাত হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়।
বহুল জনসংখ্যার আমাদের এই দেশের সিংহভাগই দরিদ্র হওয়ায় তাদের প্রয়োজনীয় বাসস্থান নেই। বাংলাদেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা হাতে নিয়েছে নানা প্রকল্প। একই সাথে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন বেসরাকারি এনজিও সংস্থা। তেমনি একটি জাতীয় পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি)।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পিকেএসএফ সহযোগিতায় এনডিপি নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর আবাসন অবস্থার উন্নয়নের জন্য বিগত অক্টোবর ২০১৬ সাল হতে সিরাজগঞ্জ ও ঈশ্বরদী পৌরসভায় “লো ইনকাম কমিউনিটি হাউজিং সাপোর্ট প্রজেক্ট(এলআইসিএইচএসপি)” শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়াও সংস্থাটি পিকেএসএফ এর অর্থায়নে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রিত গৃহায়ণ তহবিল থেকে প্রাপ্ত তহবিলের মাধ্যমে আবাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
এনডিপি নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে সহজ শর্তে স্বল্প লভ্যাংশে গৃহ নির্মাণের জন্য ঋণ সহায়তা দিয়ে নিজস্ব প্রকৌশলীর মাধ্যমে কারিগরি সহায়তা দিয়ে গৃহ নির্মাণ নিশ্চিত করে থাকে। এ ধরণের কার্যক্রমের ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার ফলে তাদের হৃদয়ে কিছুটা হলেও শান্তি ও স্বস্তি এসেছে। যদিও এ সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
সুবিধা ভোগীদের সাথে আলোচনায় যানা যায়, ইতোপূর্বে যারা ভাসমান জীবনযাপন করতেন তারা নানা রকম সংক্রামক ব্যাধি যেমন- ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতেন।
এছাড়া সুবিধাবঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রজনন সংক্রান্ত, মাতৃত্বজনিত, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক অসুস্থতার কারণে দুর্বিসহ জীবন যাপন করতেন। গৃহায়নের উন্নয়নের ফলে তারা বিরূপ এবং প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছেন। একইভাবে সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চত হওয়ার কারণে কিছু উষ্ণমণ্ডলীয় রোগ বা Neglected Tropical Diseases (NTD) থেকে তারা মুক্তি পাচ্ছেন। একই সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে নারী ও শিশুরা নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে। আশা করা যায় এ কার্যক্রমের ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুও হ্রাস পাবে। শুধু গৃহ নির্মাণের ফলে মানুষের জীবনের টেকসই উন্নয়নের নানামুখী লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। গৃহায়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রাপ্তি যেমন সম্পৃক্ত তেমনি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রসমূহেও ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।
এব্যাপারে সিরাজগঞ্জ পৌরসভার সুবিধাভোগী আমিনা খাতুন জানান, আমরা স্বামী একজন ইটভাটা শ্রমিক। আগে পরিবার নিয়ে রাস্তার ধারে ভাঙ্গা বাড়িতে থাকতাম। আমাদের যা উপার্যন হত তা ছেলে মেয়েদের ডালভাত খেয়ে কোনমতে চলে যেতে। পরিবেশ ভাল না থাকায় অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। বর্তমানে আমি এনডিপি থেকে কম লাভে এবং দির্ঘমেয়াদী আবাসন ঋণ নিয়ে ভালও একটা বাড়ি করেছি। এখন পরিবার নিয়ে অনেক সুখে আছি। পরিবেশ ভাল থাকায় অসুখ-বিসুখও কম হয়।
ঈশ্বরদী পৌরসভার উপকারভোগী জানান আসমা বেগম জানায়, আমার ৩ তো মাইয়্যা। বিয়ার বয়স হইছে। বাড়ি নাই দেইখ্যা বিয়া দিবার পারতাছিলাম না। এনডিপি থাইক্যা লোন নিয়া ভালো একখান বাড়ি করছি এখন। সমাজের মানসের কাছে দামও পাই। আবার আল্লার ইচ্ছায় মাইয়্যাকে ভালো ঘরে দিছি।
এব্যাপারে এনডিপির পরিচালক (ঋণ সহয়তা কর্মসূচি) মোসলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, এনডিপি একটি জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা। সংস্থার বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৪২টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে, তার মধ্যে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসন ঋণ কর্মসূচি অন্যতম। এ কর্মসূচির মাধ্যমে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রদান করে কারীগরি সহায়তার মাধ্যমে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা বা গৃহ নির্মাণ নিশ্চিত করা হয়। এ খাতে সিরাজগঞ্জ ও ঈশ্ব^রদী পৌরসভায় ৯৮৯ জনের মাঝে ২৫.৮৭ কেটি টাকা, সিরাজগঞ্জ জেলার সিরাজগঞ্জ সদর, শাহাজাদপুর, উল্লাপাড়া ও কামারখন্দ উপজেলায় পিকেএসএফ এর অর্থায়নে পরিচালিত আবাসন খাত থেকে প্রাপ্ত তহবিল থেকে ৬১১জনের মাঝে ১৪.৫৯ কোটি টাকা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রিত “গৃহায়ন তহবিল” থেকে প্রাপ্ত সাধারণ খাত থেকে ১২৫ জনের মাঝে ১.০০ কোটি টাক্ া এবং মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রাপ্ত তহবিল থেকে ৬৬ জনের মাঝে ০.৮৬ কোট টাকা এবং সর্বমোট ৪২.৩২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে ১৭৯১টি গৃহ নির্মাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। ঋণ বিতরণ করে গৃহ নির্মাণ নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এ কার্যক্রম অব্যহত আছে। এ ধরণের কার্যকমের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন ও স্যানিটেশনের উন্নয়ন হয়েছে, ফলে জাতীসংঘ ঘোষিত এসডিজি গোল ০৬ ার্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে।
সংস্থার নির্বাহী পরিচাল আলাউদ্দিন খান বলেন, প্রত্যেক মানুষই চায় তার স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর আবাসন, চায় সামাজিক মর্যাদা। আমার বিশ্বাস এনডিপি আবাসন কর্মসূচির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে ভুমিকা রাখতে পেরেছে। ব্যতিক্রমি এই প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মএলাকার স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয়েছে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, উন্নয়ন হয়েছে পারিবারিক শিক্ষা, উপার্জন, বৃদ্ধি পেয়েছে সামাজিক মর্যাদা। অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ‘সবার জন্য আবাসন’ বাস্তবায়ন ও এসডিজি-১১ অর্জনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি) এর মত সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ শর্তে ও জামানত বিহীন দীঘমেয়াদী ঋণ সুবিধা প্রদান করলে দেশের মানুষের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা সহজ হবে ।