কাজীপুরসিরাজগঞ্জ

কাজীপুরের কম্বলে উত্তরের শীত নিবারণ

কাজীপুর প্রতিনিধ: যমুনার ভাঙন কবলিত সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলা। বারবার ভাঙনে ফসলি জমি হারিয়ে দিশেহারা এখানকার বাসিন্দারা। তারা চেষ্টা করেন বিকল্প কর্মসংস্থানের। তাইতো প্রায় দুই যুগ আগে উপজেলার বরশীভাঙ্গা গ্রামের সাইদুল হক হঠাৎই একদিন চলে যান রাজধানীর মিরপুরে। তারপর ঝুট কাপড় কিনে এনে সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। জোড়াতালির সেই কম্বল সাইকেলের পেছনে তুলে বিক্রি শুরু করেন গ্রামে গ্রামে। সে থেকেই পথ চলা কাজীপুরের কম্বল পল্লীর। তার দেখাদেখি কম্বল তৈরি করে আর পিছু তাকাতে হয়নি এই পল্লীর মানুষের। শীতের আগমনীতে কম্বল পল্লীতে বিরামহীন কাজ করে চলেছেন কারিগররা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কম্বল পল্লী সরগরম হয়ে উঠেছে।

উপজেলার শিমলুদাইড়, বর্শীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, বরইতলা, মুসলিমপাড়া, মানিকপটল, গাড়াবেড়, হরিনাথপুর, ভবানীপুর, মাথাইলচাপড়, রৌহাবাড়ী, পলাশপুর, বিলচতল, লক্ষীপুর, বেলতৈল, চকপাড়া, চালিতাডাঙ্গা, কবিহার, হাটশিরাসহ প্রায় ত্রিশটি গ্রামের ৩০ থেকে ৩৫ হাজার নারী পুরুষ কম্বল তৈরির সঙ্গে

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আর এই কম্বল শিল্পের প্রাণ কেন্দ্র শিমুলদাইড় বাজার। প্রায় ২০ বছর ধরে এই বাজারে কম্বল তৈরির কাজ চলছে।

জানা গেছে, বছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত কম্বল ও শিশুদের শীতবস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন এখানকার কারিগর ও শ্রমিকরা। এই ছয় মাসে কাজের চাপ থাকে অনেক বেশি। কারিগররা কম্বল তৈরির চাপ কমে গেলেই অন্যান্য পেশায় জড়িয়ে পরেন। নারায়নগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে পরিত্যক্ত কাপড় কিনে এনে তৈরি করা হয় কম্বল। এই কম্বল সেলাই করেই এখানকার হাজারো নারী পুরুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই কম্বল দিয়েই উত্তরাঞ্চলসহ দেশের প্রায় ৪০টি জেলার হাজার হাজার হতদরিদ্র পরিবার শীত নিবারণ করেন।

ব্যবসায়িদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২২০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে কম্বল তৈরির রোল কাপড় গুলো আমদানি করা হয়। ওজন ভিত্তিতে প্রতি কেজি কাপড় থেকে ৩ থেকে ৫টি কম্বল তৈরি করা হয়। মানভেদে প্রতিটি এক কাপড়ের কম্বল ৮৫ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।

শিমুলদাইড় গ্রামের আম্বিয়া নামের এক কারিগর বলেন, ‘বাড়ির কামের ফাঁকে কম্বল বানাই। বেটি স্কুল থাইকা আইসা সেলাই করে। আর আমি কাপড় কাইটা সাইজ কইরা দেই। পতিদিন ১৫০ টাকার উপর কামাই কইরবার পারি।’

সাতকয়া গ্রামের আসমা বলেন, ‘মহাজনের থাইকা কাপড় নিছি। আমার বাড়ির দুইটা সেলাই মেশিন দিয়া বিটি আর আমি সেলাই করি। পুরুষ মাইসের থাইকা টাকা নেয়া নাগে না। আমাগোরে টেহা দিয়া আমরাই চলি’

বকুল মিয়া নামের এক কারিগর বলেন, আমি শিমুলদাইড় বাজারে সারা বছরই শুধু কাপড় কাটার কাজ করি। প্রতিদিন গড়ে ৭০০ টাকা থাকে।

রাসেল রানা নামের এক কারিগর বলেন, ‘আমি অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছি। সপ্তাহে দুয়েকদিন কলেজে যাই। বাকী সময় এখানে কাপড় ভাজের কাজ করে লেখাপড়া ও হাত খরচ বাদে পরিবারকেও সহযোগিতা করতে পারি।’

ঝুট কম্বল ব্যবসায়ি বেলাল মিয়া বলেন, একটি ঝুট কম্বল ১০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ৩-৪ কেজি ঝুট কাপড়েই একটি জোড়া কম্বল বানানো যায়। নারায়নগঞ্জ থেকে ১৫-২০ টাকা কেজি দরে এই ঝুট কাপড়কিনে আনি। যা গত বছর ছিল ১০-১২ টাকা কেজি। প্রতিটি কম্বল তৈরি করতে কারিগরকে মজুরি দিতে হয় ১৫ থেকে ৪০ টাকা। গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে নারী কারিগররা এগুলো তৈরি করেন।

রাজু মিয়া নামের এক ব্যবসায়ি বলেন, আমি শুধু শিশুদের শীতের পোশাক বিক্রি করি। ঝুট কাপড় সেলাই করে এগুলো বানানো হয়। ১০ থেকে ২০ টাকার মধ্যেই এই পোশাক পাওয়া যায়।

কম্বল ব্যবসায়ি আব্দুস ছালাম বলেন, সব কিছুর দাম বাড়ায় এবছর কম্বলের দাম একটু বেশি। গতবার যে কম্বলের দাম ১৯২ টাকা ছিল সেটি এবার বিক্রি করতে হচ্ছে ২১৭ টাকায়। পাইকাররা এসে কম্বল দেখে দরদাম করে ক্রয় করেন। বেশির ভাগ সময় মোবাইলেই কেনাকাটা করা হয়। টাকা পরিশোধ করেন ব্যাংকের মাধ্যমে।

কম্বল ব্যবসায়ি শরিফুল ইসলাম সোহেল বলেন, সুতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় কাপড়ের দামও বেশি। অন্যদিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সপ্তাহে একদিন কারখানা বন্ধ থাকায় কাপড় উৎপাদন কম হচ্ছে। পুরো শীতের সময় কম্বলের চাহিদা বাড়বে তখন কাপড়ই পাওয়া যাবে না।

তিনি আরও বলেন, কম্বল শিল্পের প্রসারে ইউএনও স্যার গতবার দেশের সব ডিসি ও ইউএনওকে সরকারি বরাদ্দের শীতবস্ত্র কিনতে ডিওলেটার দিয়েছিলেন। ভালো সারাও পেয়েছিলাম।

কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুখময় সরকার বলেন, সরকারিভাবে এখনও শীতবস্ত্র কেনা শুরু হয়নি। যখন শুরু হবে আমিও প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক বরাবর ডিও পাঠাবো। যাতে করে কাজীপুরের কম্বল শিল্প দেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button