ইসমাইল হোসেন,
নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি কর্মকান্ডের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের শতকরা ৭৬ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং গ্রামের মানুষের শতকরা ৯০ ভাগ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের জিডিপি’তে কৃষির অবদান প্রায় ১২% যেখানে দেশের প্রায় ৪৪% শ্রমশক্তি নিয়োজিত আছে বিধায় কৃষিই হচ্ছে বালাদেশের মাুনষের আয় ও কর্মসংস্থানের মূল উৎস। কৃষির উপরই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচিত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদাপন্নতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশের জল-ভূতাত্তিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারনে সৃষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব দেশের বেশকিছু ক্ষেত্রে পরিবেশের উপরও পড়ে। এবং এর বেশি প্রভাব কৃষির উপরই বিদ্যমান।
দেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী, যমুনার তীরে সিরাজগঞ্জ অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের ব্যাপক বন্যা প্রবণ জেলাগুলোর মধ্যে এই জেলা অন্যতম। জেলার মোট ৯ টি উপজেলার মধ্যে ৫ টি উপজেলা ব্যাপক বন্যা প্রবণ। বন্যা ও নদী ভাঙ্গন দ্বারা প্রভাবিত যা বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার উপর নির্ভরশীল। অতএব এই এলাকা জলবায়ু পরিবর্তন সংবেদনশীল, যার সর্বশেষ এবং সর্ববৃহৎ প্রভাব কৃষির উপরে পড়ে ।
সারা দেশের ন্যায় সিরাজগঞ্জ জেলাও ক্রান্তীয় মৌসুমী বায়ূ দ্বারা প্রভাবিত। ছয়টি আবহাওয়া ঋতুর মধ্যে এই জেলায় তিনটি কৃষি ঋতু স্পষ্টভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। বৃষ্টিপাত এই এলাকার পানির প্রধান উৎস। মার্চ এবং এপ্রিল মাস শুস্ক মৌসুম। এ সময় তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে এবং আর্দ্রতা থাকে কম। এ সময় মাঝে মাঝে কাল বৈশাখি ঝড় হয়। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষা বিরাজ করে এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৯০ শতাংশ সাধারণত এই সময়ের মধ্যে হয়ে থাকে। বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে হয়ে থাকে এবং সর্বোচ্চ আর্দ্রতা থাকে জুলাই মাসে। শীত সাধারণত নভেম্বর মাসে শুরু হয় এবং শেষ হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। এ সময় খুব ঠান্ডা থাকে, বৃষ্টিপাত সাধারণত হয় না, হলেও খুব কম হয়ে থাকে। এলাকায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা সাধারণত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে অনুভূত হয়। সিরাজগঞ্জ এলাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনুভূত হয় ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে, যা কখনও কখনও ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয়ে থাকে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২/৪৩ ডিগ্রি যা অনুভূত হয়ে থাকে এপ্রিল-মে মাসে।
সিরাজগঞ্জে বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপন্ন হলেও উৎপাদন ও দেশের প্রধান খাদ্য হিসাবে গুরুত্বের দিক থেকে আবশ্যিকভাবে ধান এই জেলার অত্যন্ত প্রাধান্য বিস্তারকারী ফসল। জেলার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি কৃষি জমিতে ধান উৎপন্ন হয়। অন্যান্য উৎপাদিত ফসলের মধ্যে গম, পাট, আলু, কলাই, আখ, মরিচ, তৈল বীজ (সরিষা, তিল, তিসি) চীনাবাদাম, সবজি ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। বিভিন্ন উপাদান যেগুলি এই এলাকার কৃষিকে নিয়ন্ত্রণ করে তথা কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব বিস্তার করে তা হলো ফলন মৌসুম, খরা বা উচ্চ তাপমাত্রা, সম্ভাব্য বাস্পীভবন, ভারী বৃষ্টিপাত, বন্যা, শৈত প্রবাহ ইত্যাদি। এসব বিবেচনায় সিরাজগঞ্জ জেলায় তিনটি কৃষি মৌসুম রয়েছে যেমন: রবি মৌসুম- অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, খরিফ-১ মৌসুম- মার্চ থেকে জুন এবং খরিফ-২ মৌসুম- জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর; মাঝে, মাঝারী উঁচু ও নিচু জমিতে সেচের সাহায্যে বোরো ধান চাষ করা হয়। তৈল বীজ (সরিষা) ফসল, ডাল বীজ (মাসকলাই) ফসল, গম, চীনাবাদাম, আলু, সবজি মূলত রবি মৌসুমে চাষ হয়ে থাকে। বোরো ধান, পাট, আউশ ধান, খেসাড়ী, কিছু কিছু তৈল বীজ ফসল খরিফ মৌসুমের ফসল।
সিরাজগঞ্জ জেলা এলাকার জলবায়ু পরিবর্তন প্রবণতা বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। জেলার কোথাও কোথাও কখনও কখনও দিনের বেলা খুব গরম থাকে এবং রাতের বেলা ঠান্ডা থাকে। বৃষ্টিপাতের বিষয়টাও কখনও কখনও অত্যাধিক হয় কখনও অনাবৃষ্টি বা খরা থাকে। এলাকায় রবি মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমান খুবই কম থাকে কখনও কখনও যা সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে আসে, তীব্র খরা অনুভূত হয়। কখনও কখনও খরা প্রবণতার পর বৃষ্টিপাতের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে অতিবৃষ্টিতে রুপান্তরিত হয়। রবি মৌসুমে গড় তাপমাত্রা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে স্থিতিশীল থাকলেও পরের মৌসুমে তা কমতে থাকে। অন্যদিকে রবি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাতা প্রায়ই স্থির থাকে। খরিপ মৌসুমের গড় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা সময়ভেদে পরিবর্তিত হলেও গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্থির থাকে। সিরাজগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে বিগত বছর গুলিতে বন্যা স্তরে সর্বনিম্ন পানিস্তর ও উচ্চ পানিস্তর দুই ক্ষেত্রেই ক্রমবর্ধমান উর্দ্ধমুখী প্রবণতা পাওয়া যায়। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে বিগত ৪০ বছরের (১৯৮০-২০২০) খরা পবণতা, তার পূর্বের ৩০ (১৯৫১-১৯৮০) বছরের খরা প্রবণতার চেয়ে ক্রমবর্ধমান উর্দ্ধমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জেলার বিভিন্ন স্থান ভেদে খরা প্রবণ এলাকায় কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তনে খরার প্রবণতা সাধারণভাবে লক্ষ্যনীয়।
পানি অন্যতম একটি জলবায়ূ উপাদান- যা ফসলে মাটির পুষ্টি প্রাপ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফসলের দৈহিক গঠন ও বিস্তারকে প্রভাবিত করে এবং এটি ফসলের বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজন হয় এবং সঙ্কটকালীন সময়ে পানি ন্যুনতম স্তরে না থাকলে ফসল বাঁচতে পারে না। অন্যদিকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারনে বন্যা বা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় যা ফসলের ক্ষতির কারণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফসলের বেড়ে উঠার সময়ে বৃষ্টিপাতের তারতম্য এর উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্য বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ফসলে উপর প্রভাব বিস্তার করে থকে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের পরিমান এবং বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা এমনকি শীত কিংবা অন্য কোন শুস্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাতের তারতম্যের পরিমানও ফসলের উৎপাদশীলতাকে প্রভাবিত করে থাকে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনায় বিলম্বে এমনকি আগাম বৃষ্টিপাত বীজের অঙ্কুরোদগম কমিয়ে দেয়। যার ফলে কৃষককে একাধিকবার বা অতিরিক্ত বীজ বপন করতে হয়। আবার এমনও জানা গেছে যে দীর্ঘ শুস্ক মৌসুম বা খরা প্রবণতার কারনেও ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। তবে শীতকালে বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্যের কারনে রবি শস্য যেমন আলু, সবজি, বাদাম ইত্যাদি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়ে বরং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় কিংবা উৎপাদন প্রায় একই রকম থাকে। সেচ নির্ভরশীলতার কারনে বৃষ্টিপাতের তারতম্যের প্রভাবে ধান উৎপাদন হার উঠানামা করে কিন্তু গম বা ডাল বীজ ফসল উৎপাদন কমে যায়। মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্যের কারনে ধান, সরিষা ও গম উৎপাদন হার উঠানামা করলেও অনেক সময় দেখা গেছে মসলা ফসল, ডাল ফসল এবং বাদামের ক্ষেত্রে উৎপাদন সাধারণত বৃদ্ধি পায়। খরিপ মৌসুমে রোপা আমনে উৎপাদন প্রায় একই রকম থাকলেও বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্যের কারনে সবজি উৎপাদন হার উঠানামা করে।
তাপমাত্রা একটি পরিবর্তনশীল উপাদান যা সময়, ঋতু, অক্ষাংশ, উচ্চতা, ঢাল, দিক, মাটির গঠন, উদ্ভিদ আবরণ এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাপমাত্রা পরিবর্তনের উপর ফসল উৎপাদনশীলতা খুব বেশি সংবেদনশীল থাকে। প্রতিটি ফসলের জন্য তাদের উদ্ভিজ্জ ও প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধির নির্দিষ্ট একটি তাপমাত্রা পরিসীমা আছে। যখন তাপমাত্রা এই পরিসীমার নি¤œমাত্রার চেয়ে কম বা উচ্চমাত্রার চেয়ে বেশি হয় তখন ফসল উৎপাদন বাধার সম্মুখীন হয়। উদ্ভিজ্জ, প্রজনন ও পরিণত সময়ে পরিসীমার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পরিবর্তিত হলেই এলাকায় ফসল উৎপাদন প্রভাবিত হয়। আমন ধান উৎপাদনে এর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা গেছে। গম ও আলু উৎপাদনে পরিসীমার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি/৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পরিবর্তিত হলেই মারাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বন্যা সমতল এলাকায় তাপমাত্রা পরিবর্তনের বিষয়টি কখনও কখনও ফসল উৎপাদনের জন্য সহায়কও হয়ে থাকে। রবি মৌসুমে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারনে ধান, গম ও আলু উৎপাদন কমে যায় কিন্তু মসলা ফসল ও ডাল ফসল উৎপাদন বাড়ে অন্যদিকে সব্জি উৎপাদনে তেমন কোন প্রভাব ফেলে না। এটাও দেখা গেছে যে খরিপ মৌসুমে গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারনে এবং গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারনে ধান ও ডাল ফসল উৎপাদন কমলেও সরিষা ও মসলা ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। গড় সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে সব্জি উৎপাদন কমে ও বেড়ে যাওয়ার কারনে সব্জি উৎপাদন বাড়ে কিন্তু রোপা আমনে এর কোনরুপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না।
আবহাওয়ার তারতম্য, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির প্রভাবে সৃষ্ট অতিবৃষ্টি, বন্যা, অনাবৃষ্টি, খরা, শৈত্যপ্রবাহ, শিলাবৃষ্টি, ঝড়, ঘূর্ণীঝড় ইত্যাদির কারণে প্রায় প্রতি বছরই সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের কৃষির ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। যার ফলে কৃষক বিশেষত প্রান্তিক কৃষকগণ সর্বশান্ত হয়ে যান। তবুও পরের বছর আবার তাঁরা আশায় বুক বাঁধেন যদি কোন দৈব দূর্রিপাক না হয় তবে হয়ত তাঁরা কিছু ফসল ঘরে তুলতে পারবেন, বছরের কিছুটা সময়ের জন্য হলেও অন্নের সংস্থান হবে এই আশায় ঋণগ্রস্থ হয়েও পরের বছর আবার ফসল উৎপাদনে নামেন আবার কোন না কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ হয় তাঁরা আবার সর্বশান্ত হন এবং কোন এক সময় দেনার দায়ে ভিটেমাটি হাতছাড়া করে নিরুদ্দেশে স্থানান্তরিত হতে হয়।
কৃষি বাংলাদেশের আদিমতম পেশা, এদেশের কৃষক আদিমতম কৃষি পেশার মানুষ- কালের পরিক্রমায় কৃষির উন্নয়নের জন্য দেশে বহুবিধ কার্যকর পদক্ষেপ গৃহিত হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে নতুন-নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তিত হয়েছে, চাষাবাদ পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে কিন্তু দূভার্গ্যজনকভাবে সূদীর্ঘকালব্যাপি জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবজনিত কৃষি ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ সেভাবে গৃহিত হয়েছে বলে সাধারণ মানুষ বিশেষত ভ’ক্তভোগী কৃষকগণ জানেন না। অথচ যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে কৃষির উপর নির্ভরশীল সেহেতু এই খাতে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই ছিল। সরকারী তথ্য মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৭৯ টি বীমা কোম্পানী কাজ করছে যার মধ্যে ৩৩ টি জীবন বীমাকারী কোম্পানী ও ৪৬ টি সাধারণ (অ-জীবন) বীমাকারী কোম্পানী রয়েছে। সাধারণ (অ-জীবন) বীমাকারী কোম্পানীগুলো বহুবিধ বিষয়ে বীমা সেবা দিয়ে থাকে কিন্তু হতাশাজনকভাবে কৃষিক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ খুব সামান্য বা নাই বললেই চলে। অথচ একটু প্রগতিশীল চিন্তা থেকে, দেশজ উন্নয়ন ধারার চিন্তা মাথায় নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মুনাফামুখী কর্মকান্ড নিয়ে যদি তাঁরা কৃষিক্ষেত্রে এগিয়ে আসত তবে এ দেশের কৃষকগণজলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবজনিত তাদের অনাকাঙ্খিত ক্ষয়-ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেয়ার সূযোগ পেত।
কিন্তু অনেক আগে হওয়ার কথা ছিল, এতদিন হয়নি- বলে তো আর চুপ করে থাকলে চলবে না। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে, সূচনা করতে হবে, উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে না হলে সমাজ, দেশ, জাতি সামনের দিকে অগ্রসরহবে কি করে? ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি), সিরাজগঞ্জ সেই ব্রতটি নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তারা এই সেক্টরে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে চায় যাতে করে অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেকেই এগিয়ে আসে এবং কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত জনিত যে ক্ষয়-ক্ষতি তা পূরণের একটা বহু বিস্তৃত সূযোগ সৃষ্টি হয়।
ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি), সিরাজগঞ্জ ভিত্তিক একটি জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সংস্থাটি সিরাজগঞ্জ থেকে এর যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে দেশের ৫ টি বিভাগের ১৯ টি জেলায় এর কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। এনডিপি বর্তমানে সাত লক্ষাধিক প্রত্যক্ষ উপকারভোগী নিয়ে কৃষি উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, জ্বালানী ও পরিবেশ, দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত অভিযোজন, অধিকার ও সুশাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন এই কয়টি বৃহত্তর উন্নয়ন ক্ষেত্রে চল্লিশটিরও বেশি প্রকল্প/কর্মসূচি নিয়ে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছে।এনডিপি’র নির্বাচিত উপকারভোগী শ্রেণীতে দরিদ্র, অতিদরিদ্র মানুষ- নারী, শিশু, বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি, বিভিন্ন পেশাজীবী জনগোষ্ঠি বিশেষত; প্রান্তিক কৃষক, কৃষক, ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ী, তাঁতি, পরিবহন শ্রমিক, রিক্সা-ভ্যান চালক, উদ্যোক্তা, কারিগর ইত্যাদি রয়েছে।
এনডিপি যেহেতু কৃষক তথা প্রান্তিক চাষীদের নিয়ে কাজ করে এবং বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জ অন্যতম, এখানে প্রায় প্রতিবছর অতিবৃষ্টি ও বন্যা হয় এছাড়া অনাবৃষ্টি ও খরা, শৈত্য প্রবাহ, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে এলাকার অন্যতম কৃষি ফসল ধান, ভূট্রা, গম, সরিষা, অন্যান্য তৈল বীজ ফসল, ডাল ফসল, মসলা ফসল, আলু, সবজি ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। কৃষকদের নিত্য হাহাকারের সাক্ষি হয়ে এনডিপি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সচেতনতা, সতর্কতা, পূর্বপ্রস্তুতি, সাড়াদান, পূনর্বাসন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে কিন্তু তা ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় খুবই নগন্য হওয়ায় কৃষকদের হাহাকার থেকেই যায়।
এহেন পরিস্থিতিতে এনডিপি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের ৯ মাস (অক্টোবর ২০২০ হতে জুন ২০২১) এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরের পুরো মেয়াদে (জুলাই ২০২১-জুন ২০২২) অক্সফাম ইন বাংলাদেশ এর আর্থিক সহযোগিতায় “Resilience through Economic Empowerment, Climate Adaptation, Leadership and Learning-REECALL” নামে একটি প্রকল্প সিরাজগঞ্জ জেলার ছয়টি উপজেলা- সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, কামারখন্দ, উল্লাপাড়া এবং রায়গঞ্জ এ বাস্তবায়ন করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হলো জলবায়ূ পরিবর্তন অভিঘাতজনিত ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি স্থানান্তরের কৌশল হিসাবে বীমা কার্যক্রমের প্রচার ও প্রসার, একটি স্থায়ীত্বশীল শস্য বীমা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটানো যাতে করে জলবায়ূ পরিবর্তন অভিঘাতজনিত ক্ষয়-ক্ষতি ঝুঁকির মাঝেও কৃষকদের ন্যুনতম আয়ের নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হয়; এবং বীমা কোম্পানী কর্তৃক গৎবাঁধা কার্যক্রমের বাইরে এসে অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার আলোকে কৃষকদের ঝুঁকি গ্রহণ করা। বর্ণীত উদ্দেশ্যসমুহ হাসিলের লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় এনডিপি দুই মেয়াদে বেশকিছু কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করেছে।
এইক্ষেত্রে সবকিছুর আগে এনডিপি সংশ্লিষ্ট খাতে কর্মী প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে অক্সফাম ইন বাংলাদেশ ও গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স এর প্রশিক্ষণ ফ্যাসিলিটেশন সহযোগিতায় প্রথম দফায় ১০০ জন এবং দ্বিতীয় দফায় ১২০ জন কর্মকর্তাকে আবহাওয়ার সূচকভিত্তিক শস্য বীমার উপর প্রশিক্ষিত করে, যাতে করে এই প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাগণ পরবর্তীতে কৃষক প্রশিক্ষণে কৃষকদের মাঝে এ ব্যাপারে সচেতনা সৃষ্টি তথা বীমা, শস্য বীমা, আবহাওয়া সূূচক ভিত্তিক শস্য বীমা, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষকদের ফসল চাষ পরিকল্পনা, আবহাওয়ার তারতম্য, ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা, বীমা প্রিমিয়াম, বীমা পলিসি খোলা, ক্ষয় ক্ষতি নিরুপন, বীমা পে-আউট ইত্যাদি বিষয়ে পরিস্কার ধারনা প্রদান তথা কৃষক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পারে। বর্ণীত প্রকল্পটি এনডিপি তার ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির ১২ টি শাখার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে । ১২ টি শাখার সকল কর্মকর্তা, লাইন ম্যানেজমেন্ট এর কর্মকর্তাগণ সবমিলিয়ে বিপুল সংখ্যক জনবল এই কর্মসূচির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এইসব প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাগণের মাধ্যমে এবং অক্সফাম ইন বাংলাদেশ ও গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স এর কারিগরি সহযোগিতায় পরবর্তীতে এনডিপি প্রথম দফায় ৩ হাজার ৯০০ জন এবং দ্বিতীয় দফায় ২ হাজার ৮৮০ জন কৃষককে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমা বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে। উঠান বৈঠক ভিত্তিক কৃষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটি পরিচালনার সময় নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচিত কৃষক অংশগ্রহণ করলেও বিষয়ের নতুনত্বের কারণে আশে পাশের অনেক নারী, পুরুষ ও আদিবাসি কৃষক কৌতুহলবশত পাশে জমায়েত হয়ে প্রশিক্ষণের বিষয়গুলি মনযোগ দিয়ে শুনতে থাকে যার সুস্পষ্ট প্রভাব পরবর্তীতে বীমা পলিসি খোলার সময় পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রশিক্ষণকালিন সময় থেকেই কৃষকগণ আবহাওয়ার সূচক ভিত্তিক শস্য বীমা বিষয়টিতে বেশ উৎসাহিত হয় এবং বীমা বিষয়ে তাদের আগ্রহের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
প্রকল্পের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি একটা ভাল ইন্স্যুরেন্স প্রোডাক্ট নিয়ে মাঠে আসার জন্য এনডিপি, গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর সাথে কখনও সরাসরি, কখনও অক্সফাম ইন বাংলাদেশ এর মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ করে। গ্র্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী এ বিষয়ে অনুকূল সাড়া দেয় এবং প্রকল্পে কর্মী ও কৃষক প্রশিক্ষণে সহযোগিতা প্রদানসহ সিরাজগঞ্জ এলাকার কৃষি পরিস্থিতি, এলাকার শস্য সূচি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এলাকায় মৌসুম ভেদে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, কৃষকের ক্ষয়ক্ষতির ধরণ ও পরিমান ইত্যাদি বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে আলোচনা (এফজিডি) পরিচালনা করে এবং বছরের শুরুর দিকে বোরো মৌসুম ২০২২ কে সামনে রেখে অতিবৃষ্টি ও খরা প্রবাহের সূচক ভিত্তিতে একটা ইন্স্যুরেন্স টার্মসীট এনডিপিকে সরবরাহ করে।
গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড সরবরাহকৃত টার্মসীট মোতাবেক এনডিপি কৃষকদের কাছে যায় এবং বীমা পলিসির জন্য প্রস্তাব পেশ করলে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে। খুব অল্পসময়ের মধ্যে ৪ হাজার ১৫৮ জন কৃষক পলিসি করার ব্যাপারে আগ্রহী হয় ২০২২ বোরা মৌসুমে অসময়ে সৃষ্ট বৃষ্টিপাতের কারণে বোরো ধানের ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার অভিলাষে প্রিমিয়াম পরিশোধ করে। কৃষি বীমার ক্ষেত্রে সম্ভবত এটাই প্রথম ঘটনা যেখানে কৃষকগণ কোন প্রকল্প অনুদান ছাড়াই প্রিমিয়ামের শতভাগ টাকা নগদে পরিশোধ করে। এনডিপি মাঠ পর্যায় থেকে সংগৃহিত প্রিমিয়াম জিডিআইসি এর নিকট পলিসি প্রিমিয়াম হিসাবে পরিশোধ করে নির্দিষ্ট শর্তাধীনে আবহাওয়া সূচক ভিত্তিক শস্য বীমা বোরো-২০২২ মৌসুমের জন্য ৪ হাজার ১৫৮ জন কৃষকের পক্ষে একটি পলিসি খোলে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় বীমা মেয়াদ জুন ১৫, ২০২২ খ্রি. অতিক্রান্ত হয়েছে, এনডিপি থেকে বীমা কোম্পানীর সাথে সেল ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানী, গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড থেকে এখনও কিছু জানা যায়নি, শিঘ্রই জানা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের বীমার আওতায় আছে দুইকোটিরও কম মানুষ। যেখানে সাধারণ মানুষ তথা কৃষক শ্রেণির অংশগ্রহণ খুব কম কিংবা নাই বললেই চলে। বিশ্লেষকরা বলছেন বীমা কোম্পানী গুলোর প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এই খাতে মানুষের অংশগ্রহণ কম হওয়ার অন্যতম কারণ। যদিও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা “ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি-ওউজঅ” উভয়ই বলছে বীমা নিয়ে নতুন আইন হয়েছে। ফলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসতে শুরু করেছে। অন্যদিকে এই প্রকল্পের উদ্যোগ থেকে বীমা বিষয়ে কৃষকদের মাঝে যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে অনুধাবন করে বীমা কোম্পানীগুলো অতি-মুনাফামুখি গতানুগতিক বীমা সেবা থেকে বেরিয়ে সত্যিকার অর্থে কল্যাণমূখী বীমা সেবা নিশ্চিৎ করতে সক্ষম হয় তাহলে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ বীমার সাথে সম্পৃক্ত হবে সেকথা জোর দিয়ে বলা যায়।
আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় বীমা পলিসি সিরাজগঞ্জ জেলার মানুষের জন্য একটি টেষ্ট কেস বলা যেতে পারে। এর পে-আউট প্রক্রিয়া যদি সহজতর হয়, কৃষকগণ যদি পলিসি থেকে ন্যুনতম উপকৃত হচ্ছে বলে প্রতিয়মান হয় তবে সিরাজগঞ্জে কৃষি বীমা বিস্তার অনেকদূর এগিয়ে যাবে এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এর সফল সম্প্রসারণ সহজতর হবে।