ইমাম গাজ্জালী
‘রশিদ ইঞ্জিনিয়রের চায়ের দোকান’ শিরোনামে লেখক মনিরুজ্জামান খানের আরেকটি উপন্যাস প্রকাশিত হল। বরাবরের মত তার এই উপন্যাসেও বাংলাদেশের ধর্মীয় কাঠামোবদ্ধ পশ্চাৎপদ ও অপরাধপ্রবণ সমাজের কিছু কিছু অসঙ্গতির ওপর আলো ফেলা হয়েছে। তবে বক্ষমান উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য কি? এ বিষয়ে বলা যেতে পারে মধ্যশ্রেণির মনোজাগতিক গঠন, তাদের ঠুনকো ইগো আর সস্তা প্রেস্টিজবোধ, যার গালে সজোরে চপোটঘাত হেনেছেন লেখক। আপাত নিরীহ একটি ঘটনা দিয়ে কিভাবে মধ্যশ্রেণির মনোজগতের ওপর কতবড় ঝড় বইয়ে দেওয়া যায়, এই উপন্যাসে মনিরুজ্জামান খান দেখিয়ে দিয়েছেন।
উপন্যাসের মূল গল্পে দেখা যায়, হারুনুর রশিদ নামে একজন ইঞ্জিনিয়র, যাকে সৎ চাকুরিজীবী বললে পুরোটা বলা হয় না, একই সঙ্গে তিনি একজন সোজা সাপটা এবং শক্ত চরিত্রের মানুষ। এ ধরণের বৈশিষ্ট সাধারণত মধ্যশ্রেণির মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার। রশিদ ইঞ্জিনিয়র নিজে ঘুষ খান না, অন্যের ঘুষ খাওয়া সহ্য করেন না। অফিসে ঘুষ খাওয়াও তিনি বন্ধ করে দেন। এজন্য বন্ধুহীন হয়ে পড়েন, পুরাদস্তর এই অপরাধপ্রবণ প্রশাসনে কী ঊর্ধ্বস্তন কী অধস্তন, পদে পদে সকলের বিরাগভাজন হন। কুলিয়ে উঠতে না পেরে তিনি শেষে চাকুরি ছেড়ে দেন। উপার্জনের জন্য পছন্দের আর কোনো পথ না পেয়ে তিনি পৈত্রিক বাড়ির সামনের আঙ্গিনায় একটি চায়ের দোকান দেন। আপাত নিরীহ এই ঘটনায় হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যায়। আর যায় কোথায়? এতদিনের বন্ধু মহল তাকে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে, তাকে এড়িয়ে চলে। সমাজের অনেকেই ছি ছি করতে থাকে, এমনকি এতদিনের বিয়ে করা বউ রওশন আরা, দুই সন্তান রেখে রশিদ ইঞ্জিনিয়রকে ডিফোর্স দিয়ে চলে যায়, বিয়ে করেন শহরের বড় ডাক্তারকে। বজায় রাখেন তার ঠাটবাট। এ সবই ঘটে শুধু ওই প্রেস্টিজের কারণে। এই মহিলার প্রেস্টিজের কাছে পরাজিত হয় চিরায়ত মাতৃত্ব, আর তার সাজানো সংসার। বড় পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা রওশন আরার ‘প্রেস্টিজ’ খুঁজে পাওয়া যায় শুধু দুহাতে টাকা উড়ানো আর রেয়ার কালেকশনের দামি দামি পোশাক আর স্বর্ণালঙ্কারের মধ্যে। সুকুমারবৃত্তি, সমৃদ্ধ জীবনবোধ ও মানবিকবোধের মধ্যে রওশন আরাদের প্রেষ্টিজবোধ খুঁজে পাওয়া যায় না। রওশন আরাদের প্রেস্টিজবোধ এতটাই ঠুনকো ও সস্তা যে, সেটা রক্ষা করতে গিয়েই এক পর্যায়ে তার সাধের ‘প্রেস্টিজ’ তাসের ঘরের মত খান খান হয়ে ভেঙে যায়, যখন তারই হাতে অসাবধানতাবশত: কাজের মেয়ের মৃত্যু ঘটে। কোনো কারসাজিতেই যখন ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হয়নি, যখন পুলিশ তাকে হাতকড়া লাগিয়ে প্রিজনভ্যানে তুলে নিয়ে যায়, ঘটনা যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়, তখন বোঝা যায় তার প্রেস্টিজবোধ কত হাস্যকর, কত ঠুনকে, কত সস্তা। শুধু চায়ের দোকান দেওয়ার কারণে ইঞ্জিনিয়র স্বামীকে ছেড়ে চলে আসা কতটা অপরিণামদর্শি সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা বোঝার ক্ষমতাও থাকে না এই প্রেস্টিজওয়ালীর। তাছাড়া ততদিনে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়। শেষে আত্মহননের মধ্য দিয়ে রওশন আরা গল্পের যবনিকা ঘটে।
উপন্যাসে আরেক প্রেস্টিজওয়ালা কফিল উদ্দিন। ঘুষখোর এই কেরাণী নানা কারসাজি করে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হন। নিজেকে ‘জাতে’ তোলার জন্য ছেলেকে আমেরিকা পাঠায়। কারণ আমেরিকায় ছেলেকে পাঠালে তাদের প্রেস্টিজ বাড়ে। এসব কথা বড় গলায় বলতে পারলে যেন তার বুক গর্বে এক হাত ফুলে ওঠে। সংখ্যালঘুর জায়গা দখল করে বিশাল অট্টলিকা বানায়, বিলেতি কুত্তা পুষেন শুধু ‘প্রেস্টিজ’ ওপরে তোলার জন্য। তার পরিণতিও হয় রওশন আরার চেয়েও করুণ। নতুন অট্টলিকা উদ্বোধনের আনন্দঘন মুহুর্তে যখন তার আমেরিকা প্রবাসী ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শোনে, তখন তার প্রেস্টিজের মৃত্যুর আগেই নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই ঘুষখোর প্রেস্টিজওয়ালা কেরাণী। এ যেন তার প্রেস্টিজের প্রতি সময়ের নিষ্ঠুর কৌতুক।
লেখক বর্তমানের ঔপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ এই অনুন্নত রাষ্ট্রকে ঘাটাতে যাননি, যা সকল অনাচারের উৎস। সেটা রাষ্ট্র বিজ্ঞানির কাজ। রাজনীতি নিয়ে নিশ্চুপ থেকেছেন, যেখান থেকে সমাধান আসতে পারে, যা রাজনীতিবিদদের কাজ। তিনি সমাজের মধ্যশ্রেণির একটি নির্দ্দিষ্ট সমস্যাকে উপন্যাসে চিনিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের মতে, হাজার বছর ধরে বিদেশি শক্তির (আর্য, শক, হুন, দল, কর্ণাটকি, মোঘল, তুর্কি, পাঠান ও ব্রিটিশ) আগ্রাসন শোষণ লুণ্ঠনে পিষ্ট হয়েছেন এখানকার মানুষ। ফলশ্রুতিতে আত্মবোধহীন, আত্মমর্যাদাহীন অপরাধপ্রবণ একটি জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। সেই জনগোষ্ঠীর ওপরের একটি অংশ যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে ফুলে ফেপে ওঠে, তারা খণ্ডিত আধুনিকতার দেখা পান। এরা আধুনিক নন, আধুনিকতার অনুকৃতি, বলা যেতে পারে তারা ‘ঔপনিবেশিক আধুনিক’ মানুষ। সাতচল্লিসে দেশ বিভাগের পর ওই শ্রেণিও পুর্ব বাংলা থেকে চলে যায়, তার স্থলাভিষিক্ত হয় আরেক ভাগ্যেন্বেষী শ্রেণি, তারাও অনুকৃতির অনুকৃতি, আরো পশ্চাৎপদ। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তাকে প্রতিস্থাপন করে জায়গা নেয় আরেকটি দুর্বৃত্ত মধ্য শ্রেণি। জ্ঞান বিজ্ঞানে অপরিপক্ক এই শ্রেণির বড় অংশ আবার উন্নত বিশ্বে নিজেদের ভাগ্য নির্মাণে ব্যপৃত হন। আর তলানীতে থাকা বাকি অংশের হাতেই থাকে দেশের ভাগ্য। আমাদের মতে, রওশন আরা, কফিল উদ্দিনরা সেই তলানীরই একটি স্তরের প্রতিনিধি।
রশিদ ইঞ্জিনিয়রের চায়ের দোকান উপন্যাসে আরো কিছু বিষয়ের ওপর আলো ফেলা হয়েছে। টর্চ লাইট যেমন একটি নির্দ্দিষ্ট জায়গা আলোকিত করতে গিয়ে চারপাশে আরো কিছু জায়গাও কম করে হলেও আলোকিত করে। তেমনি এই উপন্যাসে আরো কিছু চরিত্র এসেছে। যেমন নাসিমা আলফাজ দম্পতির গল্প, রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে শুভর ভবিষ্যত বলার কাহিনী আর গ্রাফিক্স ডিজাইনে ভালো পারফর্ম করা সেলিমের আত্মবিশ্বাস। এসব ঘটনায় লেখক দেখাতে চেয়েছেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আলাদা আলাদা সৃজনশীল ক্ষমতা আছে, তার প্রতি একটি ঝোঁকও আছে। তার বাইরে গেলে সেই মানুষ কখনও ভালো কিছু করতে পারে না। ব্যক্তির নির্দ্দিষ্ট সৃজনশীলতা চিনতে পারার মধ্যেই তার সাফল্য নির্ভর করে। তবে এসব গল্পের উপস্থাপনা খুব দুর্বল বলে মনে হয়।
রশিদ ইঞ্জিনিয়রের চায়ের দোকান উপন্যাসের প্লট ভালো, গল্পের গাধুনি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। উপন্যাসটি দাঁড় করাতে লেখক খুব তড়িঘড়ি করে ফেলেছেন বলে আমাদের ধারণা। লেখকের যথেষ্ট পরিশ্রম যত্ন এবং মনোযোগ পেলে উপন্যাসটি আরো সমৃদ্ধ হতে পারত। বিষয়টি নিয়ে আরো ভালো কাজ করার সুযোগ আছে।
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে “স্বপ্ন ’৭১”। প্রচ্ছদ একেঁছেন ইমরান হাসান, এটি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম মাহবুবুল হক পাঠাগারের একটি উদ্যোগ। মূল্য রাখা হয়েছে ৩৫০ টাকা। রকমারি, প্রথমা ডটকম, বাতিঘর, বইচারিতা; উদার আকাশ (ভারত) থেকে বইটি সংগ্রহ করা যাবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।