জাতীয়রাজনীতিসাহিত্যসিরাজগঞ্জ

জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি

Eye Hospital Rajshahi

এম খায়রুল কবীর

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সারা দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠেছে। বলতে গেলে, সমগ্র বাংলার মানুষ স্বাধিকার আদায়ের এক প্রচন্ড অঙ্গীকারে দীপ্ত।

ঠিক এমনি এক সময় শর্ট ওয়েভের ৭৫ মিটার ব্যান্ডে আকস্মিকভাবে শোনা গেলো- ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ সামান্য এক কিলোয়াট শক্তিসম্পন্ন এই কেন্দ্রটি তখন অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হলো সিরাজগঞ্জ শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত ‘আলফা ইলেকট্রিক সার্ভিস’-এ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে, এটি কোন সরকারি অনুমোদন ব্যতিরেকেই চালু করা হলো। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করা। পরবর্তী সময়ে যা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল।

এই বেতার কেন্দ্রটি অল্পপরিসর একটি কক্ষে একটি ট্রান্সমিটার, একটি মাইক্রোফোন, একটি চেঞ্জার ও কিছু দেশাত্মবোধক গানের রেকর্ডকে সম্বল করে চালু করা হয় অসহযোগ আন্দোলনের প্রায় সূচনা থেকেই। প্রথমতঃ প্রত্যহ সকাল, বিকাল ও রাতে এক ঘন্টা করে সর্বমোট তিন ঘন্টার অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। অনুষ্ঠানে থাকতো বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর পর্যালোচনা, বিভিন্ন কথিকা, খবর, নাটক ও দেশাত্মবোধক গান।

কিছুদিনের মধ্যেই বেতার কেন্দ্রে এসে পৌঁছালো ৭ই মার্চের ঘোড়দৌড় মাঠে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ডটি। তারপর থেকে এই রেকর্ডটি বাজিয়েই প্রত্যেকটি অধিবেশন শুরু করা হতো।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয় সম্পূর্ণভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের ডেমোনেস্ট্রেটর জ্যোতি ভাইয়ের (চৌধুরী মোতাহার হোসেন, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। তাঁকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন, সিরাজগঞ্জ শহরের মোক্তারপাড়ার দক্ষিণ মাথায় বাজার স্টেশন রোডে অবস্থিত আলফা ইলেকট্রিক সার্ভিস-এর মালিক সাত্তার ভাই (শেখ আবদুস সাত্তার আলফা, বর্তমানে প্রয়াত) ও ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শেষ বর্ষের ছাত্র বাচ্চু ভাই। এ তিনজনের নিরলস পরিশ্রমের ফসল এই ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’। জ্যোতি ভাই যান্ত্রিক প্রকৌশলের বিষয়ে মূল দায়িত্ব পালন করেন। সাত্তার ভাই তাঁর দোকানসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, বিদ্যুৎ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ ও খরচপাতি দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন। এ তিনজন অক্লান্ত শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে বেতার কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেন।

এই বেতারের অনুষ্ঠান তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার প্রায় ১০ বর্গমাইল (১৬ বর্গকিলোমিটার) দূরত্বের স্থানগুলোতেও বেশ স্পষ্টভাবে শোনা যেতে লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যেই জনগণের মাঝে এই কেন্দ্রটির জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বেড়ে গেলো এবং সবার কাছ থেকেই এই কেন্দ্রটিকে আরো শক্তিশালী করার অনুরোধ আসতে লাগলো। এ সময় বেতারের সম্প্রচার দূরত্ব সম্পর্কেও জরিপ করতে প্রায়ই সাত্তার ভাই ও জ্যোতি ভাই মোটরসাইকেলে করে শহরের বাইরে চলে যেতেন। এখানে উল্লেখযোগ্য, এই কেন্দ্রটির ব্যয়ভার উল্লিখিত তিনজন প্রকৌশলীই তখন পর্যন্ত বহন করে আসছিলেন।

হঠাৎ করে পঁচিশে মার্চের সেই ভয়াবহ বীভৎস রাতটি নেমে এলো বাংলার বুকে। কুখ্যাত পাক-সেনারা শুরু করলো বাংলার নিরীহ- নিরস্ত্র জনগণের উপর পৈশাচিক অত্যাচার। ট্যাংক-কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞে। এ খবর পাবার সাথে সাথেই দেশের অন্যান্য স্থানের মতো সিরাজগঞ্জ শহরেও শুরু হয় শত্রু-প্রতিরোধ সংগ্রামের সার্বিক প্রস্তুতি। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদ অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধা গড়ে তোলেন। এঁরা সবাই তখন সক্রিয় হয়ে ওঠেন শক্রদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার বজ্র শপথে। সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন দিকে তাঁরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরালো করে তোলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রটিকে আরো সক্রিয় করে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তাঁরা এই কেন্দ্রের তিনজন প্রকৌশলীসহ অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করলেন এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য দিলেন এই কেন্দ্রটিকে শক্তিশালী করার জন্যে। তারপর থেকেই তাঁরা নিয়মিতভাবে অর্থসাহায্য দিতে লাগলেন। এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদের নামও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। তিনিও বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন এ কেন্দ্রটিকে।

এদিকে জ্যোতিভাইসহ সাত্তার ভাই ও বাচ্চু ভাই দিনরাত অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে ‘জয়বাংলা বেতার কেন্দ্র’কে আরো জোরালো করে তুলতে সমর্থ হলেন। এপ্রিলের গোড়ার দিকে এই কেন্দ্রটির অনুষ্ঠান পঁচিশ থেকে ত্রিশ বর্গমাইল (৪০-৪৮ বর্গকিলোমিটার) পর্যন্ত শোনা যেতে লাগলো। ফলে প্রতিটি অধিবেশনের সময় আরো এক ঘন্টা করে বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এই ছয় ঘন্টার অনুষ্ঠানে সন্নিবেশিত হলো- বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, রাজনৈতিক পর্যালোচনা, কথিকা, ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ ও আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ বেতার ভাষণ, বিভিন্ন নির্দেশাবলী, সংবাদ নিবন্ধ ও পর্যালোচনা, গণমুখী নাটক, গীতি-নক্সা, সাহিত্যের আসর ও আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান ও খবর।

জনগণকে স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তখন ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’ যেন এক নতুন ভূমিকা গ্রহণ করলো। বিভিন্নভাবে এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণকে হানাদার শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার জন্য উৎসাহিত করা হতো।

এখানে বলা প্রয়োজন যে প্রথম দিকে সিরাজগঞ্জের সশস্ত্র মুক্তিফৌজ ও গেরিলারা হানাদার পাকবাহিনীকে কয়েকটি যুদ্ধক্ষেত্রে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি নরপশুদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার মতো অস্ত্র-শস্ত্রের অভাবে শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যান অস্ত্র সংগ্রহ করে শত্রুর বিরুদ্ধে আবার লড়ার অদম্য আশা নিয়ে। এ সময় চিন্তা করা হয়, সিরাজগঞ্জ শহর পাক হানাদার বাহিনীর দখলে চলে আসলেও ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রটির সম্প্রচার অব্যাহত রাখতে হবে। তবে বর্তমান অবস্থানে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সিরাজগঞ্জ শহরের কাছাকাছি বসতবাড়ি সংলগ্ন একটা জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে মাটির নিচে গোপন বেতার কেন্দ্রটি করতে হবে। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন হবে ইট, সিমেন্ট, বালি, টিন, কাঠ, বিদ্যুৎ সরঞ্জাম, জেনারেটর, অর্থ এবং বিশ্বস্ত রাজমিস্ত্রি ও সাহায্যকারী। বিষয়টি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদারকে অবহিত করা হলো। তিনি জেনারেটরসহ সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বেতার কেন্দ্রটির স্থান নির্বাচনের জন্য বললেন। শহরের চারপাশের গ্রামগুলোতে অনুসন্ধান চালানো হলো। এই অনুসন্ধান কাজে বেশ কয়েক দিন চলে গেলো। যখন মন মতো স্থান পাওয়া গেলো, তখন হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরের খুব কাছে চলে এসেছে এবং আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে একে একে। এই সুযোগে পাকিস্থানি হানাদার বর্বর বাহিনী তিন দিক দিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকে পড়ে। সেই সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের ২৭শে এপ্রিলের মধ্যরাত। অর্থাৎ সেদিনই স্তব্ধ হয়ে গেলো শর্ট ওয়েভের ৭৫ মিটার ব্যান্ডে প্রচারিত ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র অনুষ্ঠান। বর্বর-বাহিনী শহরে ঢুকেই সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ শহরটিকে পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলো এবং হাজার হাজার নর-নারী ও শিশু হত্যার এক বীভৎস উল্লাসে মেতে উঠলো। যার ফলে আমরা যারা জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র সাথে জড়িত ছিলাম, তারা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম গ্রামাঞ্চলের পথে-প্রান্তরে। তারপর অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে জ্যোতি ভাই, সাত্তার ভাইসহ আমরা কয়েকজন মিলিত হতে পেরেছিলাম। কিন্তু গ্রামে বেতার কেন্দ্র চালু করার সুযোগ ছিল না বলেই আমাদের পক্ষে কেন্দ্রটি চালু করা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

এবারে আসি উল্লিখিত তিনজন তরুণ প্রকৌশলী ছাড়া আর যাঁরা এই বেতার কেন্দ্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রসঙ্গে। প্রাথমিক পর্যায়ের সময় এই কেন্দ্র থেকে খবর পড়তেন মনিরুল কবীর (বর্তমানে প্রয়াত) ও মঞ্জুরুল হক মুন্না। সংবাদ পর্যালোচনা করতেন আমিনুল ইসলাম ও আবদুর রউফ পাতা (বর্তমানে প্রয়াত)। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ২৫শে মার্চের পরে এঁরা সশস্ত্র সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার ফলে বেতারে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

পরে খবর তৈরি করা ও পড়ার দায়িত্ব নিই আমি নিজে। রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শহীদ ফজলুল হক (তিনি ১২ই ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ জনৈক কুখ্যাত রাজাকারের হাতে শহীদ হন। জনাব হক একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ছিলেন)। সাহিত্যের আসর পরিচালনা ও আবৃত্তি করতেন খ, ম, আখতার হোসেন। সংবাদ নিবন্ধ লিখতেন ও পড়তেন দৈনিক আজাদের সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন শিকদার (বর্তমানে প্রয়াত)। তাছাড়া আনোয়ার হোসেন রতু, আশুতোষ বড়ুয়া, নেহাল জিন্নাহ, মঈনুল কবীর, মাসুদা বেগম ও মাসুদুর রহমান মোহন (মোহন রায়হান)সহ অনেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। নাটকে অংশগ্রহণ

করতেন স্থানীয় নাট্যশিল্পীরা। এখানে উল্লেযোগ্য যে, দৈনন্দিন অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করতাম আমি ও আনোয়ার হোসেন শিকদার। তাছাড়া অনুষ্ঠান ঘোষণা ও অন্যান্য অনুষ্ঠান আমরা দু’জন পর্যায়ক্রমে করতাম।

সিরাজগঞ্জের শিল্পীরা একক কিংবা দলীয়ভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সামছুল বারী ছানা, মনিরুল কবীর, ডা. মতিয়ার রহমান, স. ম. দৌলত উদ্দিন, শাহীন আহমেদ, মঈনুল কবীর, কানিজ জোহরা লায়লা (মায়া), কোহিনুর লায়লা (কুমকুম), ফরিদা ইয়াসমিন (সেতারা), আফরোজা বানু (ফোয়ারা), সুরাইয়া বানু (স্বপ্না), মৌসুমী লায়লা (রত্না), পুতুল রায়, রাণী খান, আবদুল কুদ্দুসসহ নাম না জানা অনেক শিল্পী; যাঁদের সবার নাম এখন মনে নেই।

জয়বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে যেসব দেশাত্মবোধক ও ভাষা আন্দোলনের গান প্রচার করা হতো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’; ‘জয় বাংলা বাংলার জয় / হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়’; ‘সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা / সোনা নয় ততো খাঁটি’; ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর / পাড়ি দিব রে’; ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’; ‘চাষাদের মুটেদের মজুরের / গরিবের নিঃস্বের ফকিরের / আমার-ই দেশ সব মানুষের’; ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’; ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা’; ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’; ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’; ‘ও আমার এ মাতৃভাষা’; ‘মাগো, ৮ই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলি নাই’; – এ

ধরনের আরও অনেক গান।

১৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ মুক্ত হয়। জয়ের আনন্দে দ্বিতীয়বারের মতো সরব হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রটি। এ সময় ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আইনসিদ্ধ নয় বিধায় এ পর্বে সপ্তাহ দুয়েক চালু থাকার পর ৩১ ডিসেম্বর ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। দাবি করা যায়, এখন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত এটিই একমাত্র সম্প্রচার কেন্দ্র। জয়বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিছু যন্ত্রাংশ উদ্ধার করে সেগুন বাগিচায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। বর্তমানে আগারগাঁও এ অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থায়ী ভবনে সংরক্ষণ করা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।।

আমরা যে সমস্ত অনুষ্ঠান প্রচার করেছি এই বেতার কেন্দ্র থেকে, তার সমস্ত খতিয়ানই আলফা ইলেকট্রিক সার্ভিসের সেই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠটির ভেতরেই ছিল। কিন্তু দোকানটি হানাদার বাহিনীর জিঘাংসা ও অবাঙ্গালীদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ায় আমাদের ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র নীরব সাক্ষীগুলোও অব্যক্ত বেদনায় নিদারুণ যন্ত্রণায় কোথায় হারিয়ে বা বিনষ্ট হয়ে গেছে, তা আজও আমাদের কাছে অজানা।

তবুও এটা সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, এই কেন্দ্রটি স্বাধীনতা আন্দোলনে জনগণকে উৎসাহিত করা ও মনোবল অটুট ও দৃঢ় করার প্রতিশ্রুতি নিয়েই একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেই পরিচালিত হয়েছে দুই পর্বে প্রায় আড়াই মাস। তবে দুঃখজনক হলেও একথা সত্য, স্বাধীনতা অর্জনের পর দীর্ঘ ৫০ বছরেও ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’ সম্পর্কে, এ কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে কোনো তথ্য সরকারি, বেসরকারি কিংবা জাতীয় কোনো পর্যায়েই উল্লেখিত হয়নি, স্বীকৃতিটুকুও মেলেনি। জাতীয় পর্যায়ে বেতার কেন্দ্রটির উল্লেখ ও স্বীকৃতির আশাটুকু বোধ হয় আজ অতিশয়োক্তি হবে না।

আমরা জানি না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের মূল্যবান পৃষ্ঠাগুলোর কোনো এক কোণে কয়েকজন তরুণের এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার কথা আদৌ লিপিবদ্ধ হবে কিনা। তবে এটা ঠিক যে, সিরাজগঞ্জবাসীর অন্তরে চিরজাগরূক থাকবে ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’ এর কথা এবং থাকবে ভাস্বর হয়ে এই কেন্দ্রের সাথে জড়িত প্রত্যেকটি তরুণের অগ্নিশপথে দীপ্ত মুখ।

লেখক বার্ড, কুমিল্লার সাবেক মহাপরিচালক। বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত “উপজেলা ইন্টিগ্রেটেড ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ইউআইসিডিপি)’র জাতীয় পরামর্শক ও ‘বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিএসটিডি)’র মহাসচিব। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে তিনি সিরাজগঞ্জ কলেজে স্নাতক ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। নিবন্ধটি পূর্বে মুদ্রিত (সচিত্র ঝিনুক, আগস্ট, ১৯৭২ সংখ্যা) লেখকের একটি লেখায় নতুন তথ্য সংযোজন, সংশোধন ও পরিমার্জন করে তৈরি করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button