জাতীয়রাজনীতিসিরাজগঞ্জ

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও  ডা. জাফরুল্লাহ

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একটি নাম। নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে আরেকটি নাম তাহলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ।  আমৃত্যু তিনি এ প্রতিষ্ঠানকে আগলে রেখেছিলেন। ডা. জাফরুল্লাহ ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ছিল যেন একে অপরের পরিপূরক।

প্রতিষ্ঠানটির শুরুতে নাম ছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।  পরে কি করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রতে পরিণত হলো সেই ইতিহাস অনেকেরই অজানা। সেই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনসে এফআরসিএস পড়ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আর পড়ালেখায় মনযোগ দিতে পারেননি তিনি। পাকিস্তানি পাসপোর্ট পুড়িয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসে ১৯৭১ সালে ভারতের আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গড়ে তোলেন চিকিৎসা কেন্দ্র। মহান মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই অঞ্চলে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন।

আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল চিকিৎসাকেন্দ্রটি। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।  ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ডা. এমএ মবিন ছিলেন এই হাসপাতালের উদ্যোক্তা।

চিকিৎসার জন্য প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকারী। ছন, বাঁশ দিয়ে নির্মাণকরা হয়েছিল ৪৮০ শয্যার হাসপাতাল। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো ওই হাসপাতালে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি থেমে থাকেননি।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে হাসপাতালটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন ডা. জাফরুল্লাহ। কিন্তু নামের সঙ্গে বাংলাদেশ থাকায় আপত্তি আসে প্রশাসনের কাছ থেকে। বিষয়টি কোনোভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতে পারেন।  এরপর জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।  জাফরুল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে বলেন,‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল করতে দেওয়া হচ্ছে না’। বঙ্গবন্ধু বললেন,‘বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক কর হাসপাতালের জন্য,’

শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই তিনটি নাম ঠিক করবি। আমি তিনটি নাম ঠিক করব। দুজন বসে যে নামটি ভালো হবে সেই নামে হাসপাতাল হবে। ’

তিনটি নাম ঠিক করে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুব ললেন,‘বল, কি নাম ঠিক করেছিস?’

ডা. জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন,‘এক. বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, দুই. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র…। ’

তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না, দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে। ’

জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এমএ রব ও ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে পাঁচ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্যে। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ পরিবর্তিত ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করে ১৯৭২ সালে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তার সমন্বিত সমাজ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা বা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখায় দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদক লাভ করে। বর্তমানে সারাদেশে গণস্বাস্থ্যের ৪০টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে ৪৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেয়েদের ড্রাইভিং স্কুল, ভেটেরিনারি ফার্ম, রোহিঙ্গাদের জন্য ১৫টা মেডিকেল ক্যাম্প, এগ্রিকালচারাল ফার্ম, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ফার্ম রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button