চৌহালীসিরাজগঞ্জ

ঈদের সামনে খট-খট শব্দে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে চৌহালীর তাঁত পল্লী

প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁতের মাকুর শব্দে মুখরিত উপজেলার কর্মমুখর তাঁত পল্লীগুলো, পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে সামনে নিয়ে খট-খট শব্দে আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার তাঁত পল্লীগুলো । কারিগরের দিন-রাত পরিশ্রমে তৈরি হচ্ছে লুঙ্গী ও শাড়ী, বেনারসি, সিল্ক, রেশমি, কটন, জামদানি ও কাতান শাড়িতে নিপুণ হাতে আধুনিক ও শৈল্পিক কারুকার্যে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে বাহারি নকশা। একই সঙ্গে বৈশাখের আবহে শাড়িতে ঢাক-ঢোল, একতারা-দোতারা, কলসি, ঘুড়ি, নৌকা, হাতপাখা, মাছ ধরার পলো প্রভৃতি ছবি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।

সরেজমিনে গেলে তাঁত মালিকগণ বলেন, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারজাত করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে তুলনা করে বাজারজাত করতে পারছেন না, রং ও সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে জেলার ঐতিহ্যবাহী এই তাঁতশিল্প।

জানা যায়, সরকারিভাবে এ জেলা পরিচিত তাঁতকুঞ্জ হিসেবে। জেলায় তাঁতের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষ। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ, ঈদ-উল ফিতর, ঈদুল আযহা ও পূজা-পার্বণে তাঁতের কাপড়ের চাহিদা বাড়ে। তাঁতপল্লীতে কাজের চাপ বেড়ে যায় দ্বিগুণ, রাত-দিন দম ফেলার সময় থাকে না শ্রমিকদের। আর তাই এ বছর পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে সামনে রেখে কাক ডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁত বুননের খটখট শব্দে মুখরিত এখন তাঁতপল্লী। উপজেলার তাঁত প্রধান এলাকা খ্যাত এনায়েতপুর, বেতিল, খুকনি,স্থলচর, খাষপুখুরিয়া ও ঘোরজানের প্রতিটি তাঁত পল্লীতে মালিক-শ্রমিক মিলিত হয়ে কাজ করছেন। সেই সঙ্গে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের আনাগোনাও বেড়েছে। তৈরি হচ্ছে বাহারি নামের আর নতুন নতুন ডিজাইনের আধুনিক মানের জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, বেনারসি ও বিভিন্ন ধরনের লুঙ্গি। কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতিরা। শৈল্পিক কারুকার্যে তাঁত বস্ত্রকে বাজারজাত করা হচ্ছে। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হলেও উপজেলার তাঁত পল্লীতে আবারও কর্মমুখর হয়ে ওঠায় খুশি তাঁত শ্রমিকরা।

কাপড় ব্যবসায়ী সূত্রে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা, শুভরাজ, গঙ্গারামপুর ও পাটনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বড় শহরের শো-রুমের মালিক ও পাইকাররা এখানে শাড়ি কিনতে আসছেন। তবে করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন লোকসানের মুখে থাকা এ শিল্পটি আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠায় আশার কথা বলছেন তারা।

তাঁত শ্রমিক জলিল মিয়া, শফিকুল ও মোহাম্মদ আলীসহ কয়েকজন বলেন, আমাদের মুজুরি কম, বৈশাখ ও ঈদ উপলক্ষেও কোনো বোনাস নেই। কাজ করলে মালিকরা টাকা দেন, না করলে দেন না। প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করি। রমজান মাসে খরচ একটু বেশি হচ্ছে। তাই একটু বেশিই পরিশ্রম করছি। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো নেই। কোনো রকমে বেঁচে আছি।

 তাঁত ব্যবসায়ী ফিরোজ উইভিং ফ্যাক্টরির মালিক হাজি ফিরোজ হাসান ও হাজী ফারুক হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বলেন, মার্চ মাসের শুরু থেকে পহেলা বৈশাখের আগের রাত পর্যন্ত চলে প্রিন্টিংয়ের কাজ। ঢাকার গাউছিয়া, ইসলামপুর, টাঙ্গাইলের করটিয়া, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, পাবনার আতাইকুলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কারখানা থেকে শাড়ি নিয়ে যায়। বর্তমানে বাজারে বৈশাখী শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন লোকসানের মুখে থাকায় পুঁজি সংকটে পড়েছে অধিকাংশ তাঁত মালিক। ঈদ উপলক্ষে নতুন করে শুরু করলেও রং সুতাসহ সব উপকরণের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদিত পণ্যের কাংখিত দাম পাচ্ছেন না তারা।

পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম.এ বাকী বললেন, জেলায় তাঁত শিল্পে পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম রয়েছে প্রায় ৫ লাখ। আর এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষ। সরকার কৃষি উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু বস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শিল্পের জন্য ভর্তুকির কোনো ব্যবস্থা নেই। দেশের আর্থিক খাতের জোগানদাতা বস্ত্র খাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকলে তাঁত শিল্পকে আরও গতিশীল করা সম্ভব। এজন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন তারা।

সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সুর্য বলেন, সিরাজগঞ্জের অর্থনীতি তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাই দেশীয় তাঁত শিল্প উনোয়নে সরকারকে তাঁতিদের ঋণসহ রং ও সুতায় ভর্তুকি দিতে হবে। পাশাপাশি অবৈধপথে ভারত থেকে কম দামি শাড়ি আসা বন্ধ করতে হবে। তাহলে তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button