সিরাজগঞ্জ

সমাজের মানুষকে নিরাপদ রাখতে তালগাছ রোপন করে চলেছে আজাদ

সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের তিনলাখ মানুষের একজন আবুল কালাম আজাদ। পেশায় দর্জি। কাজ করেন শহরের ২নং খলিফাপট্টীতে। পরিবার নিয়ে বাস করেন শহরের সয়াধানগড়া মধ্যপাড়ায়। পরিবারে স্ত্রীসহ চার মেয়ে। দিনরাত সেলাই মেশিন ঘুরিয়ে যা আয় করেন তা দিয়ে কোনোমত চলে সংসার। এভাবেই পার করেছেন জীবনের ৬১ বছর। টানাটানির সংসার। সংসারে আর্থিক স্বচ্ছতার জন্য প্রয়োজন আরও কিছু অর্থ। প্রয়োজন বাড়তি আরও কিছু আয়। সেসব উপেক্ষা করে কালাম ছুটছেন শীত গ্রীষ্মে রোদে-বৃষ্টিতে শহর আর গ্রামে। রোপন করছেন তাল গাছ। এভাবে আবুল কালাম ১৪ বছর ধরে শহর-গ্রামে রোপন করে চলেছেন তাল গাছ।

২১ বছর আগে বাস কালাম করতেন শহরের কল্যানী এলাকায়। বয়স তখন ৪১ বছর। সে সময় একদিন বাসায় চলছিল এক সামাজিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে নেমতন্ত্র খেতে এছিলেন দূরের এবং কাছের আত্মীয়-স্বজন। মেহমানরা আয়াসে বসে দাওয়াত খাচ্ছেন হরেক রকমের খাবার।

সেদিন আকাশ ছিল নীল। কোথাও ছিল না মেঘের আনাগোনা। হঠাৎ আকাশ ছেয়ে গেল কালো মেঘে। শুরু হলো মুশুল ধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে বিদুৎতের ঝলকানি। কানফাটা আওয়াজের মাঝে মাঝে বজ্রপাত। এক সময় প্রচন্ড এক কানফাটা আওয়াজের সাথে বিদুংতের ঝলখানিতে ভীত হয়ে পড়ল খাবার খেতে বসা মেহমানরা। শুরু হয়ে গেল হুড়াহুড়ি। ভীত-সন্ত্রস্ত মেহমানরা যে যার মতো দ্রুত নিরাপদে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটল। কেউ আশ্রয় নিল ঘরে, কেউবা আশ্রয় খুঁজে নিল বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের নিচে। কালামও কোন এক ফাঁকে নিজেকে খুঁজে পেল তালগাছের নিচে। এভাবে বজ্রবৃষ্টি চলল প্রায় আধাঘন্টা।

এক সময় বৃষ্টি থেমে গেল। থেমে গেল বজ্রপাত। কারও তেমন ক্ষতি হলো না। মেহমানরা যে-যার মতো নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওয়ান দিল। দুদিন পরে কালাম দেখল, যে তালগাছের নিচে ওরা সেদিন ওরা আশ্রয় নিয়েছিল, সেই তাল গাছের মাথার ডালপালা পুড়ে হয়েছে একাকার। কালামের মনে ভাবনার উদয় হলো। কেন পুড়ল তালগাছের মাথার ডালপালা? কেন মরে গেল তালগাছটি।

কেউ কেউ বললেন, ওই তালগাছ নিজে মরে গিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে ওর নিচে আশ্রয় নেয়া মানুষদের জীবন। বিষয়টা কালামের ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিল। তালগাছ পুড়ে মরে যাওয়ার প্রকৃত কারণ সন্ধান শুরু করলেন কালাম। সঠিক কারণ জানতে টিভিতে চোখ রাখলেন, জানলেন বজ্রপাতের কারণ, এতেও পুরো বিষয় বুঝলেন না। পরে সংবাদপত্রে বজ্রপাত বিষয়ে লেখা পড়লেন, সোসাল মিডিয়ায় বজ্রপাত নিয়ে লেখা পড়লেন। বয়স্ক, অভিজ্ঞতা সম্পন্নদের কাছে শুনলেন। এভাবেই একদিন কালামের মধ্যে ধারণা হলো বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তালগাছ সহায়তা করে। বুঝলেন, সেদিন ওর বাড়িতে যদি তালগাছ না থাকত তাহলে হয়ত কেউ মারা যেত। কালাম আরও জানলেন, প্রকৃতির পরিবর্তনে আবহাওয়া বৈরী হচ্ছে। ফলে আগামীতে বজ্রপাত আরও বাড়বে। জানলেন এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর উষতা বাড়ছে। এরজন্য প্রয়োজন বৃক্ষরোপন। এসব জেনে আবুল কালাম আজাদ সিদ্ধান্ত নিলেন, বজ্রপাত থেকে নিজে ও নিজের পরিবারকে বাঁচাতে এবং আগামী প্রজন্মকে বাঁচতে হলে তাল গাছ রোপন করতে হবে।

এসব ভাবনা থেকে কালামের মনে হয়েছে, ‘একজন মানুষ হিসেবে, একজন নাগরিক হিসেবে আমি যে পেশার সাথেই থাকি না কেন সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা থেকেই আমি তাল গাছ রোপন করা শুরু।’

কাঁচা-পাঁকা চুলের ৬২ বছর বৃদ্ধ অথচ শারিরীক অটুট বাঁধনের আবুল কালাম স্মিত হেসে যা বললেন তা থেকে জানা গেল-শুরুটা করেছিলেন ২০০৮ সালে শহরের মাঝ বরাবর প্রবাহিত সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য কাটাখালের দুধারে তালগাছ রোপনের মধ্যদিয়ে। পিছনের দিনের কথা স্মরণ করে বললেন, ‘কাটাখালে দুধারে গাছ রোপন করার পর কিছু গাছ মারা যায়। সেকারণে পুনরায় কিছু গাছ রোপন করতে হয়। এভাবে ২০০৮-০৯ সাল জুড়ে কাটাখালের দুপারে টুকু ব্রিজ-১ থেকে টুকু ব্রিজ-২ পর্যন্ত রোপন করি প্রায় হাজার ২ হাজার তাল গাছ। ২০০৮ সাল থেকে এযাবত শহর-গ্রাম সবমিলিয়ে তিনি রোপন করেছি শিয়ালকোল ইউনিয়ন, বহুলী ইউনিয়ন, খোকশাবাড়ি, কাওয়াখোলা ইউনিয়ন- খামারবাড়ি, ১ নং ক্রস বাধ, ২নং ক্রস বাধ, এরশাদ ক্লোজার, ৩নং ক্রস বাধ এবং ওয়াপদা বাধে রাণীগ্রাম বটতলা থেকে খলিশাকুড়া পর্যন্ত প্রায় দুহাজার তালগাছ। এরশাদ ক্লোজার থেকে ৩নং ক্রসবাধ পর্যন্ত রোপন ২ হাজার তালগাছ, শহরের ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে প্রায় হাজার গাছ রোপন করি। এছাড়াও, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এলাকা, বাজার স্টেশন, স্বাধীনতা স্কয়ার এলাকা সবমিলিয়ে আরও প্রায় ১ হাজার গাছ রোপন করি।’

তিনি জানালেন,পুলিশ লাইন থেকে শুরু করে গাবতলা পর্যন্ত এবং গাবতলা থেকে কয়েলগাতি পর্যন্ত খালের তীর ধরে তাল গাছ রোপন করার কার্যক্রম এখনও চলছে।

এভাবে, গত ১৪ বছরে কালাম জেলার শহর-বন্দর-গ্রামে রোপন করেছেন প্রায় প্রায় ৮ হাজার তালগাছ। এখনও চলছে কালামের তালগাছ রোপনের কাজ।

আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল কালাম দিনরাত কাজ করে সামান্য যা আয় করেন তা দিয়েই পরিচালনা করছেন সংসার। ওই অর্থ থেকে কিছু সঞ্চয় করে রোপান করছেন তালগাছ।

তাল গাছের বিচ কোথা থেকে সংগ্রহ করেন, জানতে চাইলে বলেন, তাল ও তালের বিচি সংগ্রহ করেন তাল ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে। বিনা পয়সায় তাল বিচ সরবরাহ করেন জিয়াসহ অনেক তাল ব্যবসায়ী। এছাড়াও এজন্য তাকে ছুটতে হয় জেলার হাট বাজারে। যেতে হয় দূরদুরান্ত এলাকায়।

কালাম জানান, তাছাড়া দীর্ঘ ১৪ বছরে অনেকেই জেনে গেছেন, ‘আমি তাল গাছ রোপন করি। ওই সব লোকজনের অনেকেই আমার বাসায় তালের বিচ দিয়ে যায়।’

কিরকম খরচ হয় জানতে চাইলে কালাম বলেন, ‘কাজ করতে খরচ হয়। খাতা কলমে এ হিসাব করি না। কারণ এটা আমার ব্যবসা না। এটা সখের কাজ। মানুষের জন্য একাজ করি। একাজ করি সমাজের জন্য ।’

একাজ করতে বিরুপ মন্তব্যের মুখোমুখিও হতে হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একবার সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ এর পুকুর পাড়ে তাল গাছ রোপন করছি। এসময় স্থাানীয় এক বয়স্ক লোক অনেকটাই অশালিন ভাষায় তিরস্কার করলেন। মনটা কিছুসময়ের জন্য খারাপ হয়েছিল কিন্ত ভেঙে পড়েনি।’

এখন ওই গাছগুলি বড় হয়েছে। একদিন সেই বয়স্ক লোকটি এসে জানাল আমার ধারণা ভুল তোমার কাজটি সঠিক। একথা শুনে আমি সকল কষ্ট ভুলে গেলাম। উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।

এখনতো প্রায়ই টিভি, সংবাদপত্র এবং সরকারি মাধ্যমে বজ্রপাতে লোক মারা যাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এতে করে অনেকেই বুঝতে পারছেন বজ্রপাত থেকে বাঁচতে তালগাছ লাগানো উচিত। এখন বেশির ভাগ লোক তালগাছ রোপনের প্রশংসা করে।

কতদিন লাগাবেন তালগাছ জানতে চাইলে বলেন, ‘যতদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকব ততদিন তাল গাছ রোপান করেই যাব।’

তিনি জানান তাল গাছ রোপনের শুরুর দিকে আমার পরিবার কিছুটা নিরুৎসাহিত করত। কিন্ত এখন আমার পরিবার বুঝতে পেরেছে । ফলে আমাকে উৎসাহ দেয়।

ব্যক্তি জীবনে ৬২ বছরের বিবাহিত বৃদ্ধ কালাম। কিন্ত শারিরীক বাঁধন এখনও মজবুত। স্ত্রী ও চারমেয়ে নিয়ে তার সংসার। স্ত্রী গৃহিনী। বড় মেয়ে এইচএসসি পাস করেছে। ছোট মেয়ে অনার্স পাস করে স্লাতকোত্তর পড়ছে। দুমেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং সমাপনি বর্ষে পড়ে। ছোট মেয়ে নাসিং ডিপ্লোমা অধ্যয়ন করছে।। কালামের বাবা- রহমতুল্লাহ আর মা – আনোয়ারা পৃথিবী ছেড়েছেন অনেক আগে।

বিদায়ের আগে শেষ কথায় বললেন, একাজ করতে নিজ পেশাগত কাজের ক্ষতি হয়। কিন্ত ভেবেছি সমাজের মানুষ হিসেবে কিছু ব্যক্তিগত ক্ষতি মেনে নিতেই হবে। আমি এক সাধারণ মানুষ আমার পক্ষ থেকে তালগাছ রোপনের কাজই সমাজকে বাঁচাতে একবড় ভুমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, আমার মত সমাজের সকল মানুষেরই উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে সমাজকে বাঁচাতে, সামাজিক পরিবেশকে উন্নত করতে ভুমিকা রাখা।

কথা শেষ করে ফিরে আসতে আসতে হঠাৎ মনে পড়র প্রতুল মুখোপাধায়ের একটি গানের কথা,‘ আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি, বেচো না বেচো নাা বন্ধু, তোমার চোখের মনি।’ সিরাজগঞ্জ শহরের এক সাধারণ আবুল কালাম আজাদ তার চোখেরে মনিটাতে আমাদের মত শিক্ষিত মানুষের মত বেচে দেয়নি। ফলে, অল্প শিক্ষিত কালামের চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব হয়েছে সমাজকে, যা আমরা শিক্ষিত মানুষেরা দেখিনা। দেখতে পারি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button