মো. আতিকুর রহমান রিপন : বাংলা সাহিত্যলোকে কাজী নজরুল ইসলামের অভিধা তিনি বিদ্রোহী কবি, দ্রোহের কবি,প্রেমের কবি। ক্ষণজম্না এই কবিকে কেবলমাত্র বিদ্রোহী কবি হিসেবে চিহ্নিত করলে নিঃসন্দেহে তা কমতি হবে। ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে যোগ দিতে সিরাজগঞ্জ সফর করেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। সে বছর ৫ও ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন নজরুল। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে যোগে সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন হয়ে সিরাজগঞ্জ এসেছিলেন নজরুল। কবিকে একনজর দেখার জন্য সেদিন হাজারো ছাত্র জনতা, কৃষক,কুলি মজুর জড়ো হয়েছিলো স্টেশন এলাকায়। কবিকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিলো প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি তূর্যনাদের অমর কবি সৈয়দ আসাদ-উদৌলা শিরাজীর নেতৃত্বে। সকলের মুখে আনন্দের হাসি বিদ্রোহী কবিতার স্রষ্টা নজরুল সিরাজগঞ্জের মাটিতে। খদ্দরের শেরওয়ানী,পায়জামা,চাদর,টুপি পরোহিত নজরুলকে দেখে সবাই স্লোগান শুরু করেছে আল্লাহু আকবর বিদ্রোহী কবি জিন্দাবাদ, আল্লাহ আকবার ইত্যাদি, ইত্যাদি। স্টেশনে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে কবিকে নিয়ে পূর্বেকার নাট্যভবন বর্তমানে ( ভাষানী মিলনায়তনে) যুব সম্মেলন শুরু হয়। কবি নজরুলের একনিষ্ঠ ভক্ত কালজয়ী গায়ক ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের সঙ্গীত দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। তারপর প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি সৈয়দ আসাদ -উদ্দৌলা শিরাজী বৃক্ততা করেন।তারপর কবি নজরুল তার সভাপতির বক্তৃতায় বলেন ” সিরাজগঞ্জে আসিয়া সর্বপ্রথম অভাব অনুভব করিতেছি, আমাদের মহান নেতা, বাংলার তরুণ মুসলিমের অগ্রদূত, তারুণ্যের নিশান বর্দার মৌলানা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী সাহেবের।সিরাজগঞ্জের শিরাজীর সাথে বাঙলার শিরাজ, বাংলার প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে। যাহার অনল প্রবাহ সমবাণীর গৈরিকনিংস্রাব জ্বালাময়ী ধারা মেঘ নিরন্ধ্র গগনে অপরিমান জ্যোতি সঞ্চার করিয়াছিল।নিদ্রাতুরা বঙ্গদেশে উম্মাদ আবেগ লইয়া মাতিয়া উঠিয়াছিল, অনল প্রবাহের সেই অমর কবির কন্ঠস্বর বাণীকুঞ্জে আর শুনিত পারিব না। বেহেশতের বুলবুলি বেহেশতে উড়িয়া গিয়াছে, জাতির কওমের, দেশের যে মহাক্ষতি হইয়াছে আমি শুধু তাহার কথাই বলিতেছিনা, আমি বলিতেছি একার বেদনার ক্ষতির কাহিনী। আমি তখন প্রথম কাব্যকাননে ভয়ে ভয়ে পা টিপিয়া টিপিয়া প্রবেশ করিয়াছি, ফিঙ্গে বায়স, বাজপাখির ভয়ে ভীরু পাখির মত কন্ঠে ছাড়িয়া গহিবার দুঃসাহস সঞ্চয় করিতে পারি নাই।নখ চঞ্চুর আঘাত ও যে না খাইয়াছি এমন নয়। এমনি ভীতির দু’দিনে মার্নি অর্ডার আমার নামে দশটি টাকা আসিয়া হাজির। কুপনে শিরাজী সাহেবের হাতে লেখা, তোমার লেখা পড়িয়া সুখী ইইয়া দশটি টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিও না, ব্যাথা পাইব, আমার থাকিলে দশহাজার টাকা পাঠাতাম। চোখের জলে স্নেহ সুধাসিক্ত ওই কয় পঙ্কি লেখা বারেবারে পড়িলাম। টাকা দশটি লইয়া মাথায় ঠেকাইলাম, তখনো আমি তাহাকে দেখিনাই, কাঙ্গাল ভক্তের মতো দূর হতে তাহার লেখা পড়িয়াছি, মুখস্থ করিয়াছি,শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি।সেই দিন প্রথম মানস নেত্রে কবির স্নেহ উজ্জ্বল মূতি মনে মনে রচনা করিলাম। গলায় পায়ে ফুলের মালা পরাইলাম। তারপর ফরিদপুর বঙ্গীয় প্রদাশিক কনফারেন্সে দুই দুইহাতে তাঁহার পায়ের তলার ধূলি কুড়াইয়া মাথায় মুখে মাখিলাম,তিনি আমায় একেবারে বুকের ভেতর টানিয়া লইলেন। নিজে হাতে করিয়া মিষ্টি খাওয়াইয়া দিতে লাগলেন।যেন বহুকাল পরে পিতা তাহার হারানো পুত্রকে ফিরাইয়া পাইয়াছেন। আজ সিরাজগঞ্জ আসিয়া বঙলার সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনস্বী দেশপ্রেমিকের কথাই বারে বারে মনে হইতেছে। এ যেন হজ করিতে আসিয়া কাবা শরীফ না দেখিয়া ফিরিয়া যাওয়া। তাঁহারই প্রেরনায় হয়তো আজ আমরা তরুনেরা এই যৌবনের আরাফাত ময়দানে আসিয়া মিলিত হয়েছি। এসময় কবি উপস্থিত তরুণদের উদ্দেশ্য যৌবনের গান রচনা করেন, কবি সেই মঞ্চে নারী কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।সেই মঞ্চে কবি অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে দিয়ে সিরাজগঞ্জের মানুষের হ্নদয় থেকে প্রকৃত ভালোবাসার পানি চোখ দিয়ে বের করে আনতে সক্ষম হন। কবির মর্মস্পশী কথা প্রতিটি শব্দই যেন সম্মেলনকে প্রাণব্ন্ত করে। সিরাজগঞ্জের নাট্যভবন (ভাষানী মিলনায়তন) থেকে সম্মেলন শেষে কবি আফজাল মোক্তার হোসেনের বাড়ীতে আয়োজিত সংবর্ধনা ও ভোজ সম্পূর্ণ করে ঘোড়ার গাড়ীতে চেপে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় বাণীকুঞ্জে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর সমাধি জিয়ারতে। কবি সমাধির পাশে অশ্রুসিক্ত নয়নে দু হাত তুলে দোয়া করেন।কবি নজরুল শিরাজীর স্মৃতিচারনে কেঁদে ফেলেন। এভাবে আনন্দ আর বেদনার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল বিদ্রোহী কবি নজরুলের সিরাজগঞ্জ সফর।
বিদ্রোহী কবি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর পেয়েছিলেন সিরাজগঞ্জে। সিরাজগঞ্জ যুব সম্মেলনে কবির ভাষনকে পরিমার্জিত লিখিত রুপ আকারে যৌবনের গান (অভিভাষণ)হিসেবে পরিচিত।
লেখক :
মো. আতিকুর রহমান রিপন
ব্যাংকার।
সাবেক,সদস্য (শিশু প্রকাশ, এম এম সি)।