রেহমান মিজান
লেখক, কবি, মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মী
তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আলী নোওয়াজ স্যার আমাদেরকে সামাজিক বিজ্ঞান পড়াতেন। আমার স্পস্ট মনে পড়ে স্যার পরিবারের সবক দিয়ে গিয়ে “বাবা-মা, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী,ভাই-বোন একসাথে বসবাস করাকে পরিবার বলে” বুঝিয়েছিলেন। চোখ বন্ধ করে যদি একটু ছোট্র বেলার সেই সময়টাতে চলে যাই তখন স্মৃতির দর্পনে কতই না সুন্দর সাজানো-গুছানো পরিবার ভেসে উঠে। এক হাড়িতে ২৫-৩০ জনের রান্না আর সেই খাবার একসাথে বসে খাওয়ার আনন্দ ভূলার মতো নয়। পারিবারিক বন্ধনগুলি এতো গভীর ছিল, শরীরের এক অঙ্গে আঘাত লাগলে যেমন অন্য অঙ্গ ব্যথা পায়,তেমনই পরিবারের একজনে ব্যাথা পাইলে অন্যজন সে ব্যথা অনুভব করতো। একজনের সুখে সবাই হাসতো আর একজনের দুঃখে অন্যরা সমব্যাথি হতো। পরিবারের সদস্য গুলো যেন ছিল একে অপরের প্রাণ ভোমরা। কালের স্যার আমাদের মাঝে নেই, সেটাকে প্রকৃতির নিয়ম বলে মেনে নেওয়া ছাড়া কোন গতি নাই। কিন্তু পেশাগত কারণে পরিবার নিয়ে কর্মস্থলে অবস্থান,আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ, ক্যারিয়ারের পেছনে অবিরাম ছুটে চলা, প্রাকৃতিক দূযোর্গ, নদী ভাঙ্গন বাধ্য সহায় সম্বল হারিয়ে শহরমুখি হওয়া, একটু ভাল আয়ের আশা শহরের থেকে যাওয়া, সামাজিক অস্থিরতা ও জটিল নাগরিক জীবন আমাদের এমনভাবে যান্ত্রিক করে দিয়েছে যে এখন সেই আদর্শ পরিবার ব্যবস্থা কে আমরা ভুলেতে বসেছি। এ যেন জনপ্রিয় বাঙালি সাহিত্যিক এবং নাট্যকার সেলিম আল দীন এর উক্তি ”হারাধনের গরু কিতাব এ আছে গোয়াল এ নাই” এর সাথে হুবুহুব মিলে যায়।
নগর জীবনে এসে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে ছোট-ছোট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার প্রবণতা সেই কবে থেকেই পরিলক্ষিত হয়। এখন নগর জীবনে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা খুব একটা চোখে পড়েনা; অপর পক্ষে আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পরিবার ব্যবস্থাও সময়ের সাথে সাথে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে শুর করেছে। আর এই ভেঙ্গে যাওয়ার অনেকগুলি কারণের মধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নকেই বেশী দায়ী করা যায়। সমাজবিজ্ঞানীগণ নগরায়নের জন্য দুটো কারণ (০১)পুশ-ফ্যাক্টরের (০২)পুল-ফ্যাক্টরই দায়ী করেন। তবে আমি পুল-ফ্যাক্টরকে বেশি দায়ী মনে করি, কারণ শহরের শিক্ষা,চাকুরী,চিকিৎসা, চিত্ত-বিনোদনের ব্যবস্থাসহ সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা গ্রামের মানুষকে আর্কষিত করে ফলে তারা শহরের দিকে ক্রমশঃ পাড়ি জমায়। পরিবারের সংজ্ঞা ও পরিবারের কাঠামোর ধরণটা শৈশবে,কৈশোরে,যৌবনে,বিয়ের বছর,বিয়ের প্রথম বছর, সন্তানের বাবা-মা হওয়া,শ্বশুর-শ্বাশুরি হওয়ার বিষয়গুলি কালক্রমে ভিন্ন-তর থেকে ভিন্ন-তর হতে চলেছে।
বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন আর এই বিয়ে-শাদি করানো বা দেওয়ার জন্য পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতার বিষয়ে একটা নাটকীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেশীদিন না, যদি আজ থেকে ১০-১৫ বছর পেছনে ফিরে তাকাই আমরা এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারবো। আগে কোন একটি পরিবারে মেয়ে বা ছেলে যদি বিবাহ উপযুক্ত হতো,তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আনা বা বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য শুধুমাত্র পরিবারের বাবা-মা, চাচা-চাচী, মামা-মামী, নানা-নানী,দাদা-দাদী ছাড়াও ওই বংশের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা উঠে পড়ে লাগতেন। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরাও খোঁজ-খবর রাখতেন ও সম্বুদ্ধ নিয়ে আসতেন। বর্তমান সময়ে এই রেওয়াজের বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এখনো ছেলে মেয়েদের প্রণয়জনিত বিয়েকে এখনো ভালো নজরে দেখেনা। যদিও এমন বিয়ে শাদী গ্রামীণ সমাজে এখন অহরহ হচ্ছে। আগে থেকে সম্পর্ক থাকলে এখনকার ছেলেমেয়েরা পরিবারকে জানিয়ে দেয় পরিবার ও সেটা মেনে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে-শাদী দিয়ে দেয়। এমনও দেখা গেছে ছেলে-মেয়ে পালিয়ে আদালতে গিয়ে বিয়ে করেছে। পরিবারের সম্মান ও সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেছে দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদেরকে সামাজিক আচার অনুষ্ঠান করে ধুম-ধাম করে নতুন করে আবার বিয়ে দেয়া হয়। গ্রামীণ জীবনে দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদেরকে গ্রামে এনে ধুম-ধাম করে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান করে লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়াইয়া নতুন করে বিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এখনো অনেক বিয়ে-শাদি প্রথাগতভাবে আচর-অনুষ্ঠান মেনে হলেও আধুনিক নগর ব্যবস্থায় তার উপস্থিতি অনেকটা কমেছে। নাগরিক জীবনে তথাগত ঘটক বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে বিয়ের তুলনায় ডিজিটাল ঘটক তথা ম্যারেজ মিডিয়ার উপর অনেকটা নির্ভর করার বিষয়টা পরিলক্ষিত হয়। এখানে ছেলে-মেয়ের পছন্দ বা মতের উপর গুরুত্ব দিয়ে বিয়ে এবং বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান করা হয়। নাগরিক জীবনের বিয়েতে এখন আধুনিকতার পরশ এমনভাবে লেগেছে যে, বিয়ের মুল অনুষ্ঠান কাবিন করা, কবুল বলা বা মন্ত্র পাঠ ছাড়া অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মুসলিম, হিন্দু, খ্রীষ্টান,বৌদ্ধ বা অন্যান্য জাতী-গোষ্টির বিবাহ কে আলাদা করা মুশকিল। বেকারত্ব, সম্পর্কের তিক্ত অভিজ্ঞতা, সামাজিক বন্ধনহীনতা, বিশ্বাসহীনতা, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, সন্তান পালনের অনীহা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎসহ এরকম আরো হাজারো জটিলতার কারণে তরুণ এবং যুবকদের একটা অংশ দিনে দিনে বিয়ে করার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
নাগরিক জীবনে দেখা যাচ্ছে একই বিল্ডিং এর কোন এক এপার্টমেন্ট এ কেউ একজন মারা গেছে অন্য কেউ এপার্টমেন্ট এ বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কেউ কাউকে চেনে না। দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এখানে সামাজিক বন্ধন তেমন সুদৃঢ় না। আগে থেকে যাদের পছন্দ-সম্পর্ক না থাকে। পিতা-মাতারা তাদের সন্তানের জন্য বিবাহ উপযুক্ত সুপাত্র-পাত্রী পেতে হিমশিম খেতে হয়। বিষয়টি আরো জটিল হয়ে উঠে পাত্রী যদি বিধবা বা তালাক-প্রাপ্ত হয়। নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের প্রতিষ্ঠিত হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর উচ্চবিত্তরা জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য সময়মত বিয়ে করছে না। দেশে যে পরিমাণ বিবাহপোযুক্ত পাত্রী আছে সে পরিমাণ যোগ্য পাত্রের সংকট আছে বলে আমি মনে করি। অন্যদিকে সঠিক সময়ে বিয়ে না করা আর প্রজননের সঠিক সময়ে বাচ্চা না নেওয়ার কারণে অনেক দম্পতি পরবর্তীতে সন্তান নিতে গিয়ে নানান জটিলতায় ভুগছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগ সম্প্রতি “বন্ধ্যাত্ব জটিলতা শীর্ষক” গবেষণায় পেয়েছেন যে, দেশে প্রায় ৪৫% সক্ষম দম্পতি কোন কোন বন্ধ্যত্বজনিত জটিলতা ভুগে থাকেন।
শৈশবে একটি শিশুরা তার বাবা-মা, সহোদর, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, ফুফু,নানা-নানী, খালা-মামা সান্নিধ্য পেয়ে বেড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। আগেকার দিনে পরিবারে কোন নতুন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তাকে দেখাশুনা, লালন-পালনের দায়িত্ব নিতেন তাদের অগ্রজ ভাই-বোন, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, ফুফু,নানা-নানী, মামা-খালা প্রমূখ। এসব শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির পাশা-পাশি বুদ্ধি ভিত্তিক বৃদ্ধি ও সামাজিকীকরণ হতো সঠিকভাবে। পরিবারে কোন প্রতিবন্ধী, অচল ও বয়োবৃদ্ধ থাকলে তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব মিলে-মিশে পালন করা করতো। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এর উপস্থিতি কিছুটা এখনো লক্ষ্য করা গেলেও জটিল নাগরিক জীবনে এর উপস্থিতি খুব একটা বেশী দেখা যায়না। নাগরিক জীবনে শিশুরা তার মা-বাবাকে ছাড়া আর কাউকে কাছে পায় না। বাবা-মা যদি কর্মজীবি হয় তাদের জন্য ছেলে-মেয়েদেরকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া কঠিন হয়ে উঠে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত শিশুরা বাবা-মায়ের সান্নিধ্য পায় না। শিশুরা বেড়ে উঠে অল্প-শিক্ষিত, অ-প্রশিক্ষিত কাজের বুয়া ও আয়ার মাধ্যম। যার ফলে ওই সমস্ত শিশুরা ব্যক্তিত্ব গঠনে, আচার-ব্যবহার শিখন ও সামাজিকিকরণ এর ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এখনও গ্রামের বাড়িতে অতিথি আসলে বাড়ির ছোট-বড় সবাই একে-একে এসে সালাম বিনিময় করে, পরিচিত হয় এবং গল্প করে সময় কাটায়। অন্যদিকে আধুনিক নাগরিক জীবনে বাসায় অতিথি আসলে দেখা যায় ঐ বাসার সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। আত্বীয়-স্বজন ছাড়া একা-একা বেড়ে উঠা এসব শিশুরা বাসার নতুন আগন্তুককে আপদ মনে করে। নতুন কারো সাথে মিশতে চায় না এবং ওরা নিজেকে গুটিয়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। দাদা-দাদী, চাচা-চাচীর বা আত্মীয়-স্বজন এর সাথে শিশুদের বেশী দিন থাকার সৌভাগ্য হয় না। বাবা-মায়ের বিয়ের প্রাক্কালে বা প্রথম বছর, বড় জোড় তিন বছরের মধ্যে কোন কোন অজুহাতে তাদের সাথে সম্পর্কের টানা পোড়ান সৃষ্টি হয় এবং পরিবারটি আলাদা হয়ে যায়। হাতে-গুনা কয়েকজন মানুষের সাথে উঠা বসা করে বেড়ে উঠা শিশুরা এর বাহিরের পৃথিবীটা কে আপন করে নিতে চায় না।
ইট পাথরের চার দেয়ালে বন্দি, পড়া লেখায় অত্যধিক চাপ, সঠিক নিয়মে জ্ঞানার্জন না করেও বিভিন্ন পরীক্ষায় ৯০+ নম্বরের নিশ্চয়তা চায় অভিভাবকরা। গ্লোন্ডেনসহ জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ্য প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিদিন শিশুরা “হামদু” কুলির মত বয়সের চেয়ে ৫গুন ভারী ব্যাগ বহন করে প্রাইভেট টিউটর ও কোচিং সেন্টার এ দৌড়াদৌড়ি করে । মানসিক চাপের মধ্যে থাকা এসব শারিরিকভাবে এ্যাকটিভ হওয়ার সময় ও সুযোগ কম পায় । ফলশ্রুতিতে, শিশু-কিশোরা ফাস্ট ফুড, অনলাইনে সময় কাটানো, কার্টুন দেখা সহ ভিডিও গেমস খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এবং দিনে দিনে মুটিয়ে যাচ্ছে। মেধা বিকাশ এবং জাতি গঠনে এরা পিছিয়ে পড়ে। অতি আবেগপ্রবণ এসব শিশু-কিশোররা বিভিন্ন ওকেশনে নতুন মডেলের জামা কাপড়, মোবাইল ফোন, ডিজিটাল গেজেট, গাড়ি-মোটরসাইকেল কিনতে বাবা-মা কে বাধ্য করে। বাবা-মায়ের সামর্থ্য আছে কিনা সেটা বুঝার মতো মানিবক বিবেচনাবোধ এসব শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রায়ই অনুপুস্থিত থাকে। । বড়-জোর দুই ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া, দামী পাঞ্জাবি পরে বাৎসরিক ঈদের জামাতে হাজিরা দেয়া সারা সামাজিক আসার অনুষ্ঠানে ওদের উপস্থিতি দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনেক শিশু-কিশোর আছে যারা গ্রাম কি জিনিস,গ্রাম দেখতে কেমন ও আত্মীয়তার বন্ধন কি জিনিস সেটা জানেই না। গ্রামের বাড়িতে সময় কাটানোর জন্য ছোটখাটো বাড়ি বানানোকে অর্থের অপচয় মনে করে। শিকড়ের টানে ঈদ-পূজা-পার্বণ এ গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটানোর চেয়ে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর প্রবণতা বেশি মাত্রায় লক্ষা করা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামেরও যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়ে গেছে বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন। দেখা গেছে মা-বাবা অনেক আশা করে ছেলেকে বড় করে বিয়ে করিয়েছেন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতে কোন না কোন অজুহাতে সেই সন্তান তার পরিবার নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করেছে এবং বাবা-মায়ের ভরন-পোষণ ঠিকমতো করছে না। সেটা শিক্ষিত চাকুরিজীবী কিংবা খেটে খাওয়া দিন মজুর, এক সন্তান বা একের অধিক সন্তান যাহাই হোক না কেন। একের অধিক সন্তান হলে তো একজনের ঠেলাঠেলিতে আর একজন বাবা-মায়ের যত্ন-আত্তি, চিকিৎসা-সেবা ও ভরণপোষণ করে না। পরিবারে দু-একজন প্রতিবন্ধী থাকলে তাদের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধ বয়সে এসব বাবা-মায়েরা মানবেতর জীবন-যাপন করে। তবে কিছু কিছু পরিবার তাদের বংশ পরম্পরায় তাদের পারিবারিক সম্পর্ক, পারস্পরিক সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সামাজিক বন্ধন কে এখনো দৃঢ় রেখে চলেছে। কালো এই দিগন্তের ওপারের আশার আলো গুলোকে নিভতে দেওয়া যাবে না, বরং এই আলো-গুলোকে দিনে দিনে চারোদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা প্রদান করতে ব্যর্থ হই, না তাহলে দিগন্তের ওপারে মিটিমিটি করে জ্বলা আশার প্রদিপগুলোও একটা সময় হারিয়ে যাবে। নগরায়নের জটিল জীবন আমাদেরকে অনেক আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এনে দিয়েছে এটা ঠিক, তবে মানুষের জীবনকে করে দিয়েছে সুপার ফাস্ট। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিষয়গুলোর সাথে খাপ-খাওয়াতে না পাওয়ার কারণে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে। মানুষগুলি হয়ে যাচ্ছে বেশী মাত্রায় আত্বকেন্দ্রিক। মানুষগুলোর পারিবারিক, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদীহিতা কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। যার কারণে নাগরিক ও সামাজিক জীবনে নেমে আসছে হতাশা, স্বেচ্ছাচারিতা, কিশোর অপরাধ, পারিবারিক সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতন, পারিবারিক ভাঙ্গন, বিবাহ বিচ্ছেদ, মাদকাসক্ততা, অপরাধ প্রবণতা সহ নানা ধরণের সমস্যা ও অবক্ষয়। সরকারের উচিৎ সব প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত সামাজিক নিরাপত্তামুলক কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পাশাপাশি আইনি কাঠামো তৈরি করা যাতে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মাকে ভরনপোষন করতে বাধ্য হয, যাতে আবহমান বাংলার পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে না পড়ে এবং সামাজিক অবক্ষয় রোধ হয়। সরকারের পাশা-পাশি বেসরকারী উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন গুলিও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে সামাজিক অবক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে, ব্যক্তিগতভাবে আমাদেরকে যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে, সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটানো পরিবেশ ও প্রতিবেশের সৃষ্টি করতে হবে, পরিবারকে যতেষ্ট সময় দিতে হবে। না হয় প্রাশ্চ্যাত্যের মতো আমাদের চারি-পাশ প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নিবাসে ভরে যাবে। আর এই তথাকথিত নগরায়ন চিরাচরিত বাংলার পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোকে একেবারে গ্রাস করে আমাদেরকে কঠিন এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে যা মোটেই কাম্য নয়। আসুন আমরা সচেতন হই, একে অপরের পাশে থাকি, ভালবাসতে শিখি, ভালবাসা পাই এবং ভাল থাকি।