ইসমাইল হোসেন: আমার এক বন্ধু দীর্ঘদিন প্রবাস জীবনশেষে স্থিতু হয়েছেন নিজ শহরে। প্রচুর অবসর তার এবং আমার। প্রায়শই জমে আড্ডা বন্ধুর সঙ্গে। বাঙালি জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সেই আড্ডায় থাকে না কোন নির্দিষ্ট বিষয়বস্ত। ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজ, রাষ্ট্রীয় এমনকি আন্তর্জাতিক সবই ওঠে আসে সেই আড্ডায়। অবসরে এমনি এক আড্ডায় ইউরোপে শিক্ষিত, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বন্ধু প্রশ্ন করল, তোমরা প্রেসক্লাব থেকে সাংবাদিক নিয়োগ দাও। সেই নিয়োগে কি শিক্ষাগত বিষয় অর্ন্তভুক্ত থাকে? বন্ধুর প্রশ্নে কিছুটা হতচকিয়ে গেলাম। ইউরোপে শিক্ষিত বন্ধু প্রেসক্লাব সম্পর্কে একি প্রশ্ন করল! প্রশ্নটি মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। আমার বন্ধুর মতই কি অনেকেই মনে করেন প্রেসক্লাব সাংবাদিক নিয়োগ দেয়? সুযোগ পেলেই বিষয়টি অন্য কারো সঙ্গে আলোচনায় কৌশলে নিয়ে আসতাম। এতে করে দেখলাম অনেকেই ধারণা করেন প্রেসক্লাব সাংবাদিক নিয়োগ দেয়, প্রেসক্লাব পত্রিকার কিংবা ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করে।
আসলে দুই বিষয়ের কোনটি প্রেসক্লাব করে না। মনে হলো প্রেসক্লাব সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা তুলে ধরা দরকার পত্রিকার পাঠকের দরবারে। এভাবনা থেকেই ভাবলাম দুকলম লিখিনা কেন এবিষয়ে।
আসলে প্রেসক্লাব কি? এই ক্লাব কি সাংবাদিকদের নিয়োগ দেয়? কোন পত্রিকায় কি সংবাদ প্রকাশ করবে তা কি প্রেসক্লাব নিয়ন্ত্রণ করে? এটা কি সংবাদকর্মীদের মজুরিসহ পেশাগত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির বার্গেনিং এজেন্সির ভুমিকার দায়িত্ববান প্রতিষ্ঠান?
আসলে সমাজে প্রচলিত এধারণা ভুল। কোন প্রেসক্লাবই সাংবাদিক নিয়োগ দেয় না। কোন প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সংবাদ প্রকাশের নিয়ন্ত্রণ করে না। কিংবা সাংবাদিক হতে হলে কি শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগবে তা নির্দ্ধারণ করে না। এছাড়া প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের পেশাগত মজুরি বৃদ্ধির কোন বার্গেনিং সংগঠনও নয়। এরজন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন।
প্রকৃত অর্থে এবং সাধারণ অর্থে প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের সামাজিক মিলন কেন্দ্র বা অবসর বিনোদনের কেন্দ্র কিংবা চিত্ত বিনোদনের কেন্দ্রকে বোঝায়। একই সঙ্গে প্রেস ক্লাব মুলত বুদ্ধিচর্চার পীঠস্থান হিসেবেও পরিচিত। বিশ্বের কোথাও কোথাও এধরনের প্রতিষ্ঠান প্রেসগিল্ড নামে পরিচিত।
প্রতিটি প্রেসক্লাবেই রয়েছে নিজ নিজ গঠনতন্ত্র, উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য। সব প্রেস ক্লাবের গঠন কাঠামো ও আদর্শ উদ্দেশ্য সবদেশে যেমন এক নয়। তেমনি আমাদের দেশেও প্রতিটি প্রেসক্লাবই গঠন কাঠামো ও আদর্শিক বৈশিষ্ঠগতভাবে এক নয়।
বাংলাদেশে ঢাকায় অবস্থিত প্রেসক্লাবকেই বলা হয়ে থাকে জাতীয় প্রেসক্লাব। পরিচালিত হয় নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুসারে। ঢাকার বাইরে দেশের জেলা উপজেলাতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রেস ক্লাব। এসব প্রেসক্লাবের প্রতিটি প্রেসক্লাবই স্ব নিয়ন্ত্রিত, রয়েছে গঠন কাঠামোর ভিন্নতা। রয়েছে প্রতিটি প্রেসক্লাবেরই নিজ নিজ লক্ষ্য উদ্দেশ্য।
একটু পিছনে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে প্রেস ক্লাব গঠনের চিন্তা ভাবনা শুরু হয় ভারত বিভক্তির পর থেকে। তদানিন্তন পাকিস্তান আমলে। পূর্ব বাংলায় ১৯৫২ সালে জাতীয় পর্যায়ে প্রেস ক্লাব গঠনের লক্ষ্যে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত হয় সাংবাদিকদের সম্মেলন। এই সম্মেলনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উন্থাপিত হয়। কিন্ত সেসময় পর্যন্ত এই ধারণা মজবুত না হওয়ার কারণে প্রেসক্লাব গঠন করা সম্ভব হয়নি। পরে ১৯৫৪ সালের ২০ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাব নামে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর ৭২ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রেসক্লাব নাম সংশোধন করে নাম রাখা হয় জাতীয় প্রেসক্লাব। ১৯৯৫ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাব এর পতাকা ও প্রতীক নির্বাচন করা হয়। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রেস ক্লাব এর স্থান পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে সেগুনবাগিচায় নিজস্ব স্থানে নিজস্ব ভবনে পরিচালিত হচ্ছে জাতীয় প্রেসক্লাব এর কার্যক্রম।
যদিও জাতীয় প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের একটি পেশাগত ক্লাব। কিন্ত এই ক্লাব দেশের বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ন অবদান। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গাবিরোধী শান্তি মিছিল, ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদ মিছিল-এই প্রেস ক্লাব থেকেই সূচিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় আন্দোলন সংগ্রামে জাতীয় প্রেসক্লাব ছিল কেন্দ্রস্থল। এক্লাবের নেতৃত্ব দিয়েছে মুজিবুর রহমান খান, ্তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া. এহতেমশাম হায়দার চৌধুরী, শহিদুল হক, কে জি মোস্তফা, গিয়াস কামাল চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন, আব্দুস সালাম, এ বি এম মুসা, আব্দুল আওয়াল খান, এ জেড এনায়েতুল্লাহ খান এর মত দেশের প্রথিতষশা চিন্তা চেতনায় অগ্রগামি সাংবাদিকগন। এদের ভুমিকায় প্রেসক্লাব সৃষ্টি করেছে দেশব্যাপী বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহনযোগ্যতা। শুধু ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব নয়। ঢাকার বাইরে মফস্বলের সাংবাদিকদের পেশাগত এই ক্লাবগুলো জাতির ইতিহাসে রেখেছে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা।
কিন্ত জাতীয় প্রেসক্লাব এমনকি মফস্বলের প্রতিটি প্রেসক্লাবই একক সত্ত্বা নিয়ে বিদ্যমান। অন্যদিকে কোন প্রেস ক্লাবই কোন সাংবাদিক নিয়োগ দেয় না, কোন প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্টনিকস মিডিয়ার সংবাদ প্রকাশে কোন নিয়ন্ত্রন কিংবা কোন প্রিন্ট অথবা কোন মিডিয়া হাউজের নীতি নির্দ্ধারন করে না। কিংবা কোন সাংবাদিকের কি শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকবে বা কত বয়স পর্যন্ত একজন সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করবে এসব ক্ষেত্রে কোন ভুমিকা রাখে না কিংবা ভুমিকা রাখার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান নয়। এসব ক্ষেত্রে স্ব স্ব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়াই দায়িত্ববান। এছাড়াও এরজন্য রয়েছে সাংবাদিকদের পেশাগত সংগঠন ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, রয়েছে সাংবাদিক সমিতি, রয়েছে সরকারের প্রেস কাউন্সিল ও প্রেস ইন্সষ্টিটিউট।
সাংবাদিকদের পেশাগত প্রতিষ্ঠান প্রেস ক্লাব সাধারনত আয়োজন করে থাকে সাংস্কৃতিক, সাহিত্য অথবা চিত্ত বিনোদনের জন্য নানা অনুষ্ঠান। বর্তমান সময়ে প্রেস ক্লাব হয়ে উঠেছে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের মিলন কেন্দ্র। শুধু ঢাকায় নয় ঢাকার বাইরেও প্রতিটি প্রেসক্লাবই নিজ কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে নিজ নিজ এলাকায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসন ও সুধীজনের নিকট প্রতিষ্ঠিত করেছে এ প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা।
ইদানিং প্রিন্ট ও ইলেট্রনিক মিডিয়ার বাইরে প্রকাশিত হচ্ছে অন লাইন সংবাদপত্র। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৃথকভাবে অনলাইন সাংবাদিকদের উদ্যোগে পৃথক অনলাইন প্রেসক্লাবও নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে এবং ভুমিকা রাখছে।
লেখক: দৈনিক সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন এর নির্বাহী সম্পাদক