ভাষা সৈনিক সাইফুল ইসলাম ১৯৪৮ সালে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় বন্ধু মীর আবুল হোসেন ও নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি ১৯৫০ সালে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠা করেন রেনেসাঁ ক্লাব। সাইফুল ইসলাম ছিলেন ১৯৪৮ ও ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সিরাজগঞ্জ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে আজিজ মিসির (মশিয়ুর রহমান টুংকু) ছিলেন তার সঙ্গে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।
ভাষা সৈনিক সাইফুল ইসলাম ১৯৩৩ সালের ৭ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার রহমতগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আসাদুজ্জামান তালুকদার। মাতা- আজিজুন্নেছা। শৈশবে দেড় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় স্থানীয় জ্ঞানদায়িনী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পার হয়ে ভর্তি হন বি.এল. স্কুলে ( বি.এল. সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়)। ১৯৪৭ সালে বি.এল. হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।সিরাজগঞ্জ আই আই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
সাইফুল ইসলাম ১৯৪৫ সালে কিশোর বয়সে মুকুলের মেলা ও মুকুল ফৌজ এর মাধ্যমে কিশোর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরে তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সিরাজগঞ্জ মহকুমার সহকারী সম্পাদক হিসাবে পাকিস্তান আন্দোলন যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ছেদ ঘটান লিখিল বঙ্গ ছাত্রলীগের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালে যোগ দেন ছাত্র ফেডারেশনে ।
অভিভাবকের নিকট মার্নিঅর্ডারের ফরম ফিলাপ করতেই চমদকে ওঠেন তরুন সাইফুল। স্বাধীন পাকিস্তানে মানি অর্ডার ফরমে বাংলার কোন স্থান নেই। অস্থির চিন্তে তরুণ সাইফুল ইসলাম খুঁজতে থাকেন প্রতিবাদের সংগঠন। এমন সময়ে ১৯৪৮ সালে তমুদ্দিন মজলিশ প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ পত্রিকা থেকে জানতে পারলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে সংগঠিত শক্তি রয়েছে। আগ্রহি হয়েও পিছিয়ে পড়লেন তমুদ্দিন মশলিসের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেয়ে। কোলকাতা স্ট্রেটসম্যান পত্রিকা থেকে জানতে পারলেন ১১ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করেছে ছাত্র সমাজ। তিন ভাষা সৈনিক সাইফুল ইসলাম ১৯৪৮ সালে বন্ধু মীর আবুল হোসেন ও নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন। টিনের চোঙ্গা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে প্রচার করেন ধর্মঘটের। পাতিলের কালি দিয়ে পোষ্টার লিখে গাবের আটা দিয়ে সাটিয়ে দেন দেওয়ালে। এভাবে তিন বন্ধু মিলে সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন সাইফুল ইসলাম।
৪৮ এর ভাষার আন্দোলন ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। এসময় উদু সংগীতের প্রসার। উর্দু সংস্কৃতির বিস্তারের প্রচেষ্টা এককথায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রেনেসাঁ ক্লাব।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি বর্ষনের প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জে স্বতস্ফুর্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে ধর্মঘট আহ্বান করেন ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম কমিটি। ধর্মঘটের টেউ স্কুলের গন্ডির বাইরে শ্রমজীবী মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করে। আন্দোলন জনগনকেও আলোড়িত করে। ছাত্র-শ্রমিক-রাজনীতিকদের সক্রিয় ভুমিকায় ২৩,২৪,২৫ সফল ধর্মঘট। ২৬ তারিখে জনসভা। এভাবেই ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখ থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলেন সাইফুল ইসলাম অন্যান্য সমবয়সি মানুষ ও জনতাকে সঙ্গে নিয়ে।
তিনি ছিলেন সিরাজগঞ্জে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে আজিজ মিসির (মশিয়ুর রহমান টুংকু) ছিলেন তার সঙ্গে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।
১৯৫৭ সালে যোগ দেন মওলানী আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ- ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে। গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখেন ১৯৫৭ সালে সিরাজগঞ্জের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী তমিজুল হকের পক্ষে। ওই বছরেই জীবনে প্রথমে কারাবরণ। ১৯৬৬ সালে ন্যাপ বিভক্ত হওয়ার পর তিনি যোগ দেন ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ-ন্যাপ (মস্কো গ্রুপ)। পরে একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ছিলেন।
পেশাগত জীবনে রাজনীতির বাইরে তিনি ছিলেন কখনও ব্যবসা, কখনও অধ্যাপনা পেশায় যুুক্ত। জীবনের শেষ পর্যায়ে ছিলেন স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী। তবে জীবনের দীর্ঘ সময়ে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতা পেশায়। মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, মনিং নিউজ, পাকিস্তান টাইমস এর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি ও উত্তর বঙ্গ প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে ২৬ জুন তার ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হয় স্থানীয় পত্রিকা প্রথমে পাক্ষিক ও পরে সাপ্তাহিক সমযুগ।
১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি রাজনীতি, শ্রমিক, কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কালের সাক্ষী। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সময়ে সংগ্রামী সাইফুল ইসলাম ৮ বার জেল, হুলিয়া, অন্তরীণ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার হন।
লেখালেখির অভ্যেস সেই কিশোর বয়স থেকেই। লিখেছেন ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ইতিহাস বিষয়ে। ১৯৬১ সালের ৮ মে পাবনায় প্রতিষ্ঠিত হয় মফস্বল সাংবাদিকদের পেশাগত সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতি। সাইফুল ইসলাম এই সমিতি গঠনে রাখেন গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতি সিরাজগঞ্জ মহুকুমা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৬৩ সালে সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় রাখেন মূল ভুমিকা। ১৯৬৬ সালে সিরাজগঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আয়োজনে রাখেন গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা।
১৯৭১ সালে মওলানা ভাসানী সঙ্গে ভারত গমন করেন। প্রবাসকালিন সময়ে তিনি মওলানা ভাসানীর সচিব এর দায়িত্ব পালন করেন।
২০১২ সালের ১ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের এই কৃতী সন্তান সাইফুল ইসলাম পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নেন। তাকে শায়িত করা হয় সিরাজগঞ্জ রহমতগঞ্জ পৌর কবরস্থানে।