জাতীয়শিক্ষাসাহিত্যসিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন

Eye Hospital Rajshahi

ইসমাইল হোসেন: ৪৮ সালে সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করেন তিন বন্ধু। সাইফুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম ও মীর আবুল হোসেন। লড়কে লেয়েঙ্গে পাকিস্তান- ছিনকে লেয়েঙ্গা পাকিস্তান।  হাতমে বিড়ি, মুমে পান, লড়কে লেয়েঙ্গা পাকিস্তান-  ভ্রান্তির শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান কায়েমের মুরুব্বীদের অসহযোগিতায় ৪৮ এর পর আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে।  কিন্ত এতে করেও থেমে থাকেনি সিরাজগঞ্জের ভাষা সৈনিকরা।

৪৮ এর পর উর্দ্দু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা পরিচালনা করে বাংলা ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। ৫০ সালের পর আন্দোলনে মাত্রা বাড়তে থাকে। ৫২ সালে সেই আন্দোলন নতুন করে বেগবান হয়। 

ইতিমধ্যেই ৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের তিন তরুনের একজন মীর আবুল হোসেন চলে যান গ্রামের বাড়ি। নজরুল ইসলাম চলে যান অন্য শহর। এসময় পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে ম্যাট্্িরক পাস করে আনোয়ার হোসেন রতু এবং নাটোর থেকে ম্যাট্রিক পাস করে আজিজ মেহের ভর্তি হলে সিরাজগঞ্জ কলেজে।

নতুন করে সংগঠিত হলো সিরাজগঞ্জের ভাষা আন্দোলন। আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি ভাষা সৈনিক আজিজ মেহের সিরাজগঞ্জ কলেজের বড়ইতলায় ছাত্রসভা আহ্বান করেন। সভায় কলেজ ছাত্রদের পাশাপাশি যোগ দেয় স্কুলের ছাত্ররাও। এই সভায় গঠিত হয় সিরাজগঞ্জের ৫২ এর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আর যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন আজিজ মেহের (টুংকু)। ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২১ ফেব্রুয়ারিতে সারাদিন হরতাল, মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠানের। প্রচারের প্রস্তুতিতে ১৮ জানুয়ারি শহরের বাজার স্টেশনে খোরশেদ আলমের ভাষায় গোপন প্রস্তুতি বৈঠকে অংশ নেন সাইফুল ইসলাম, মীর আবুল হোসেন, মশিউর রহমান টুংকু, আনোয়ার হোসেন রতু, তমিজুল ইসলাম, আব্দুল মমিন চাল্লি, আব্দুর রশিদ নান্নু প্রমুখ ভাষা সৈনিকরা।  ২১ জানুয়ারি রেনেসাঁ ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় আর এক পরিকল্পনা বৈঠক। সংগ্রাম কমিটি ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলা ভাষা বিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জ শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করেন।

এবং ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রেনেসাঁ ক্লাবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবাদ দিবস পালনের মধ্যদিয়ে প্রস্তুতি সভার মধ্যদিয়ে সিরাজগঞ্জের ভাষা সৈনিকরা ৫২ এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গড়ে তোলেন মজবুত ভিতের ওপর। ফলশ্রুতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলি বর্ষনের প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জে তাৎক্ষণিক স্বতস্ফুর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। এদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বন্ধ থাকে শহরের দোকানপাট। ভাষা সৈনিক সাইফুল ইসলাম, আজিজ মেহের, আনোয়ার হোসেন রতু, তমিজুল ইসলাম, সৈয়দ কায়সার আলী, মফিজ উদ্দিন, হায়দার আলী, সাহেব আলী, মুরাদুজ্জামান, আবুল হোসেন, নুরুন্নবি খান পুতুল, আব্দুল মমিন চাল্লি, আব্দুর রশিদ নান্নু, বি এল স্কুলের ছাত্র সূর্যকান্ত দে, নির্মল বসাক, হান্নান তালুকদার, জ্ঞানদায়িনী স্কুলের ছাত্র  আলী আকবর খান প্রমুখের নেতৃত্বে  হাজার হাজার ছাত্র জনতা কালো ব্যাজ ধারণ করে নুইরা-নাজিম দুই ভাই এক দড়িতে ফাঁসি চাই শ্লোগানে ভাষার দাবির মিছিল প্রকম্পিত করে শহরের রাস্তা। সেদিন ভাষার দাবির মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে চৌরাস্তা ( বর্তমানের সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব) মোড়ে এসে শেষ হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলনে প্রথমবারের মত রাস্তায় নেমে আসে নারীরা। নেতৃত্ব দেয় সরকারি সালেহা স্কুলের শিক্ষার্থী বিজলী, মেহের নিগার, হেনা, মনিকা প্রমুখ শিক্ষার্থী। ওই দিন রাতে গ্রেফতার করা হয় সাইফুল ইসলাম, তমিজুল ইসলাম, মফিজউদ্দিন তালুকদার, সৈয়দ কায়সার আলী, জাফর ইমাম ভোলা, আলী আকবরসহ অনেক ছাত্রনেতাকে।

২৩ ফেব্রুয়ারি আহুত ধর্মঘট সফল হলো। ২৪ ও ২৫ তারিখেও ধর্মঘট অব্যাহত থাকল।  আন্দোলনে যুক্ত হলেন আসগর আলী মোক্তার ও আমির হোসেন উকিল (মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালিন সভাপতি ও সম্পাদক) এর মত রাজনীতিকগন। আন্দোলনে যুক্ত হয় ফাররুখ শিয়র, সাহেব আলী (হেলাল প্রেস), হাফিজউদ্দিন তালুকদার, ছানাউল্লাহ মুন্সী, খোদা বকস রোকনী, সৈয়দ হায়দার আলী (প্রাক্তন সংসদ সদস্য), সাগির মাষ্টার, আবুল কাশেম নূরে এলাহী, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সাহাবুদ্দিন সরকার, আবুল ফাত্তাহ নূরে এলাহী, জিতেন্দ্রনাথ নিয়োগী। যুক্ত হয় সিরাজগঞ্জের শ্রমিক আন্দোলনের পুরোধা শ্রমিক নেতা কমরেড আবু বকর সিদ্দিকী, বিড়ি শ্রমিক নেতা আবুল হোসেন, শ্রমিক নেতা জসিম উদ্দিন, মহিরউদ্দিন, আব্দুল মালেক, শামছু আরও অনেকে। আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলেন রিকশা শ্রমিক, গরুর গাড়ীর শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রগতিশীল অংশ। ভাষার দাবি শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। শহরের বাইরে ফুলবাড়ি গ্রামবাসী করে প্রতিবাদ সভা। আন্দোলনে ঘটে গুনগত পরিবর্তন।

ছাত্র-শ্রমিক-রাজনীতিকদের সক্রিয়তায় ২৩,২৪,২৫,২৬ ফেব্রুয়ারিতে অভূতপূর্ব সাড়া দেয় জনতা। হরতাল দোকানপাট, কাঁচাবাজার, কোর্ট-কাচারি, অফিস বন্ধ ছিল। এসময় শহরে কোন যানবাহন চলেনি।

মোবাইল ছিল না। মাইক ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তারপরও হরতাল আর জনসভার ঢেউ উচলিয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তরকারি বিক্রেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষেরা আন্দোলনের খবর বয়ে নিয়ে গেল গ্রামে গ্রামে। দূরদুরান্ত গ্রাম থেকে ছাত্ররা শহরে এসে যোগাযোগ করল ভাষা আন্দোলনের সংগঠকদের সাথে। শহর থেকে পরামর্শ নিয়ে গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করত। সিরাজগঞ্জ শহরের বাইরে শাহজাদপুর, রায়গঞ্জ এবং উল্লাপাড়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও আন্দোলন গড়ে তুলল।

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি হতে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম চলল। মার্চ মাসে এসে আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিলেন একুশ এর শহিদদের স্মরনে শহিদ মিনার নির্মানের। যেই কথা সেই কাজ। সিরাজগঞ্জ শহরের মাঝ বরাবর নির্মিত হয়েছে ইলিয়ট ব্রীজ। লোকে বলে বড়পুল। সেই বড়পুলের পূর্বপ্রান্তের খালি জায়গায় শহিদ মিনার নির্মানের প্রস্তুতি নিল ভাষা সংগ্রামীরা। কিন্ত প্রশাসনের বাধার মুখে প্রথম শহিদ মিনার নির্মান সম্ভব হয়নি। শহিদ মিনার নির্মানের দ্বিতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহন করা হয় ১৯৫৩ সালে। ঐক্যমত হলেন রাজনীতিক, শ্রমিক এবং ছাত্রনেতারা। বড়পুরের পূর্ব পার্শ্বে পূর্ব নিদ্ধারিত স্থানেই নির্মিত হলো মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরনে শহিদ মিনার। এই শহিদ মিনারটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে সিরাজগঞ্জ রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক নূর মোহাম্মদ এর পাঁচ বছরের শিশু সন্তান জিন্নাত আলীকে।

শুধু সিরাজগঞ্জ নয়। সিরাজগঞ্জের বাইরে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে এই জেলার কৃতী সন্তান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, আব্দুল মতিন, আলী আজমল, আব্দুল মমিন তালুকদার, নুরুল আলম, ডা. মতিয়ার রহমান, ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ খান, মোতালেব খান রাখেন নেতৃত্বের ভুমিকা।

এভাবেই সিরাজগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের বাইরে জাতীয় পর্যায়ে এজেলার কৃতী সন্তানেরা বাঙালি জাতিয়তাবাদী রাজনীতি সংস্কৃতির চেতনার বিকাশে রাখেন ঐতিহাসিক ভুমিকা। এবং এই আন্দোলনের পথ ধরেই ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষাভাষি জনগনের একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button