ইসমাইল হোসেন: দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তিতে সদ্য ভুমিষ্ঠ পাকিস্তানের এক মফস্বল শহর সিরাজগঞ্জ। এই শহরের এক তরুণ তার অভিভাবকের নিকট টাকার জন্য টেলিগ্রাম করতে গেলেন পোষ্ট অফিসে। দেখলেন পোষ্ট অফিসের পোষ্টকার্ড, খাম আর মানি অর্ডার ফরমে উর্দু লেখা ছাপা রয়েছে। নেই বাংলায় কোন ছাপ। শুধু পোষ্টকার্ডই নয় পাকিস্তানি টাকার ওপরেও লেখা রয়েছে ‘হুকুমতে পাকিস্তান’। অথচ ভারত বর্ষের লক্ষকোটি মানুষের মতো এই তরুণও বৃটিশের শৃঙ্খলমুক্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাষার অধিকার থাকবে। থাকবে না শোষন আর বঞ্চনা।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে লাখো তরুনের মতো পূর্ব বাংলার উত্তরের শহর সিরাজগঞ্জের তরুণ সাইফুল ইসলামও সেই দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য মিছিলে অংশ নিতেন। শ্লোগান তুলতেন।
কিন্ত এ কি! পাকিস্তান জন্মের মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাংলাভাষী মানুষের মাঝে উর্দু প্রচলনের অপচেষ্টা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাইরে থেকে বিজাতীয় এক ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পুর্ব বাংলার মফস্বলের এই তরুনের মনটা বিষিয়ে উঠল। বাংলাভাষী জনগনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন তরুণ। তার মনের মধ্যে জন্ম নিল ক্ষুদ্ধতার। সময়টা ৪৭ সালের শেষ দিকে।
ক্ষুদ্ধ তরুণ সাইফুল ইসলাম যোগাযোগ করলেন বন্ধু মীর আবুল হোসেন আর নজরুলের সাথে। তিনজনের চিন্তার ঐক্য গড়ে উঠল। খোঁজ নিতে শুরু করলেন উর্দুকে সর্বস্তরে প্রচলনের বিরুদ্ধে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে কোথাও প্রতিবাদ হয়েছি কিনা। ৪৮ এর ভাষা আন্দোলনে চিত্র এভাবেই ওঠে এসেছে সিরাজগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের মুল সংগঠক সেদিনের তরুণ সাইফুল ইসলামের এক লেখায়। ওই লেখায় সাইফুল ইসলাম লিখেছেন-
পরদিন বন্ধু মীর আবুল হোসেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ নামের একটি পুস্তিকা হাতে দিল। ঢাকায় অবস্থিত তমুদ্দিন মজলিস পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছে। বুঝলাম ভাষার প্রশ্নে ঢাকাতেও চিন্ত ভাবনা চলছে।’ তরুণ সাইফুল বুঝলেন এরা তো রাব্বানিয়াত কায়েম করতে চায়। খেলাফত-তো কেবল একটি সম্প্রদায়ের জন্য । এ লাইন অনুসরন করলে পাশের বাড়ির নিত্যদিনের সঙ্গী কাঙ্গাল ভাই কেষ্ট নাপিতের কি হবে? কিন্ত সেই সময়ে সিরাজগঞ্জে বাম প্রগতি ও গনতান্ত্রিক ধারার কোন সংগঠন ছিল না।
ফলে বাধ্য হয়েই তিনবন্ধু যোগাযোগ করলেন তদানিন্তন মহুকুমা মুসলিম লীগ এর সেক্রেটারী প্রয়াত আবুল কাসেম মোক্তারের সঙ্গে। অনুরোধ করলেন স্থানীয়ভাবে কিছু উদ্যোগ নেয়ার। নেতা শুনলেন। কিছু একটা করবেন। আজ করবেন কাল করবেন এভাবে কেটে গেল ৪৭ পেরিয়ে ৪৮ সাল। দু’মাস মাস পেরিয়ে গেল কিন্ত নেতা কোন সিদ্ধান্ত দেন না।
সে সময় সংবাদপত্রের এতো প্রসার-প্রচার ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। কোলকাতা থেকে ট্রেন সিরাজগঞ্জ হয়েই যেত ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায়। ফলে কোলকাতার পত্রিকা ট্রেন ধরে সিরাজগঞ্জ আসত। তিনবন্ধু নিয়মিত পড়তে শুরু করলেন ঢাকার আজাদ এবং কোলকাতার ইত্তেফাক। একদিন পত্রিকা মারফত জানলেন বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১১ মার্চ স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। তিন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিবাদ করবেন।
তিন বন্ধু সিরাজগঞ্জের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১১ মার্চ ধর্মঘটের আহবান করলেন । কিন্ত স্কুল-কলেজ ঘুড়ে পেলেন না তেমন একটা সাড়া। শিক্ষার্থীরা শুনল। জানল। কিন্ত এতো কিছুর পরও কেউ এলো। সাইফুল ইসলামের ভাষায়, আসবেই কেন বাঙালি মুসলমান চেতনায় তো তখন স্রেফ পূনর্জন্মের ভাবনা। অন্যদিকে বাঙালি হিন্দু ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ পাবলিক ভয়ে সংকোচে ম্রিয়মান। কাজেই যা হবার তাই হলো। তিন তরুনে উদ্যোগের ধর্মঘট আংশিক সফল হলো।
হার মানলেন না তিন তরুণ। ইতিমধ্যে শহরে ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’ নামে পরিচিত তিন তরুণ ১১ মার্চের ধর্মঘটের অসফলতার পর আবারও উদ্যোগ নিলেন জনসভা আয়োজনের। টাকা নেই। জনসভার স্থানের অভাব। জনসমর্থনের অভাব। এতো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জনসভায় আয়োজন করলেন প্রসন্ন সাহার পাটের গুদামের মাঠে। আর্থিক অনটনের কারণে প্রচার ভালো হলো না। সাইফুল ইসলামের ভাষায়, তিন দিনে জমায়েত ডেকে ব্যর্থ হলাম। পয়লা দিন শ্রোতার কোটা শুন্য। হিন্দুস্থান ও হিন্দুর দালালদের কথা কেউ শুনতে এলো না। দ্বিতীয় দিনে বৃষ্টি নেমে পড়ল। খোদার খোদ জবানের বিরুদ্ধে সমাবেশ তাই।
সে সময় জিন্নাহর জনপ্রিয়তা বাঙালি মুসলমানদের হ্রদয় মন্দিরের গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসে আছে। সদ্য স্বাধীন দেশে পাকিস্তান ও মুসলিম লীগ এবং কায়দ-ই-আজম ছিলেন সমার্থক। স্বাধীন পাকিস্তানে নব জাতকের জিন্নাহ নাম রাখার হিড়িক পড়ে গেছে। কাজেই উর্দু, ফারসি ও আরবি একই হরফের প্রায় সমার্থক। এদের বিরোধীতা করা মানে পবিত্র ইসলামের বিরোধীতা করা। এ অবস্থায় তৃতীয় দিনে মাঠের মালিক বাধা দিলেন। শেষাবধি চতুর্থ দিন জমায়েত হল। তবে তা অতিশয় ক্ষুদ্র। সবমিলিয়ে ২০/২৫ জন। জনসভার দিনে বৃষ্টিও বাধ সাধল। স্বাদের পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর জনগনের সমর্থনও তেমন পেলেন না।
সিরাজগঞ্জ তখন ছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের মজবুত শহর। কাজেই ভাষা আন্দোলনকারীদের এই উদ্যোগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সামাজিক সুবিধাভোগকারী এবং স্থানীয় প্রশাসনের মনোকষ্টের কারণ হলো। মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান বণিক সমিতির নেতারা তিন তরুণকে ডেকে ছবক দিতেন- ওই তিন ছোকরা হিন্দু ও মুর্তিপুজার বন্দুকধারী সংস্কৃতির জারজ বাংলাকে পাক ওয়াতানের হকুমাতের জবানের দাবি তুলেছে। মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের মহুকুমা সুবেদার বলতেন- তিন বান্দরের বুকের পাটা দেখ। ওরা কায়েদ ই আজমের ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করে? এভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্থানীয় সুবিধাভোগীরা আন্দোলনের উদ্যোক্তা তরুণদের নানাভাবে হয়রানি অব্যাহত রাখলেন।
সবমিলিয়ে ৪৮ সালে সিরাজগঞ্জে তিন তরুনের নেতৃত্বে সংগঠিত ভাষা আন্দোলন স্থানীয়ভাবে জোরদারভাবে গড়ে ওঠল না। এভাবেই ৪৮ সালে মফস্বল শহর সিরাজগঞ্জের নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিন তরুনের প্রচেষ্টার ৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন একসময় ঝিমিয়ে পড়ে। সমাপ্তি ঘটে সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের।
প্রথম পর্যায়ের আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় তিন তরুণ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পরিচালিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে সাংস্কৃতিক কর্মীদের। প্রতিষ্ঠা করেন রেনেসা ক্লাব। শুরু করে উর্দু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াই। তিন তরুনের সঙ্গে যুক্ত হয় একদল তরুণ ও যুবক। প্রতিষ্ঠা করেন রেনেসা ক্লাব। তাদের পরিচালিত রেনেসাঁ ক্লাব কেন্দ্রীক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যদিয়েই সিরাজগঞ্জে ৪৮ এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ৫২ সালে এ শহরে সংঘটিত হয় সবশ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণে সফল ৫২ এর ভাষা আন্দোলন।