সাহিত্যসিরাজগঞ্জ

ভাষা সৈনিক আলী আজমল (বুলবুল ডাক্তার)

ইসমাইল হোসেন: ভাষা সৈনিক আলী আজমল ছিলেন ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংগঠক।  ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত প্রথম হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে তিনি আহত হন। আহত অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তির শর্ত অনুসারে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ধর্মঘটে জড়িত থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যানের সাথে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন আলী আজমল। এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে ১০ জনের প্রথম ব্যাচে নেতৃত্ব দেন।  ১৪৪ ধারা মানি না মানব না, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, চলো চলো অ্যাসেম্বলী চলো-শ্লোগানে ১০ জন ১০ জন করে খন্ড মিছিল দ্রুত গতিতে গেট পার হয়ে রাজপথে নামে। ১০ জনের প্রথম মিছিলে প্রথম দলের প্রথম কাতারে যিনি ছিলেন তিনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদাপুরের কৃতী সন্তান ভাষা সৈনিক প্রয়াত ডা. আলী আজমল। ভাষা সৈনিক বদরুদ্দিন আহমদ বলেন, দশজনের প্রথম ব্যাচ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতা আজমলের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করল। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল।  ৬ মাস পর তিনি মুক্তি পান।

 শাহজাদপুরে সাধারণের কাছেবুলবুল ডাক্তার খ্যাত ভাষা সৈনিক আলী আজমল ১৭ মামলার আসামি হিসেবে পুলিশের খাতায় ছিলেন মোষ্ট ওয়ানটেড। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস এর চুড়ান্ত পরীক্ষার মাত্র তিন মাস আগে বহিস্কার হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে।  ফিরে আসেন নিজ এলাকা শাহজাদপুরে। মানবতায় সেবায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন আমৃত্যু। ১৯৫৫ সালে সরকার বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সাধারণের এই চিকিৎসক বুলবুল ডাক্তারকে গ্রেফতার করে সরকার। সিলগালা করে দেয় তার চেম্বার।

ভাষা আন্দোলনের এই অকুতোভয় সৈনিক আলী আজমল বুলবুল ডাক্তার ছিলেন ডাক্তারী সার্টিফিকেট বিহীন জনগনের চিকিৎসক। এমবিবিএস পাস না হয়েও তিনি ছিলেন জনগনের বুলবুল ডাক্তার।

এই ভাষা সৈনিক জন্ম গ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের ১ মার্চ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার পাড়কোলা গ্রামে। পিতা- মোহাম্মদ সোলেমান, মাতা- জোবেদা খাতুন। ১৯৪৪ সালে তিনি রাজশাহী কলেজিয়াট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হন কোলকাতা মেডিকেল কলেজে।  নিরব কিন্ত প্রতিবাদী এই মানুষটি কোলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান ঘোষণার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলায় হাইকোর্টের রায়ে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ২য় বর্ষে। থাকতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২নং ব্যারাকের ১ নং কক্ষে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর প্রথম ছাত্রসংসদ তিনি ছিলেন নির্বাচিত কমনরুম সম্পাদক।

২০০২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সময়ে তিনি নিজ এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যান। শাহজাদপুর উপজেলা সদরে সার্টিফিকেট বিহীন অথচ একজন সফল ও যোগ্য চিকিৎসক আলী আজমল সাধারনের পরিচিত বুলবুল ডাক্তার।

আমৃত্য তিনি উত্তর বাংলার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার সাধারনের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে ছিলেন সহজ, সরল সাধারণ জীবনের প্রচার বিমুখ এক মানুষ।

ভাষা সৈনিক আলী আজমল বুলবুল ডাক্তার ২০০২ সালের ৩ অক্টোবার পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।

৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রথম মিছিলের নেতৃত্বদানকারী এই ভাষা সৈনিকের নামে শাহজাদপুর পৌরসভা পৌরশহরের একটি রাস্তার নামকরণ করেছে কিন্ত আজ অবধি রাষ্ট্র দেয়নি এই ভাষা সৈনিককে কোন সন্মাননা।

ভাষা সৈনিক আলী আজমল ৪৮ ও ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অবদানে কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও তিনি পেয়েছেন শাহজাদপুরের মানুষের ভালোবাসার বুলবুল ডাক্তার এর সন্মাননা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button