ইসমাইল হোসেন: ভাষা সৈনিক সাহিত্যিক মকবুলা মনজুর ১৯৫২ সালে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাংলা ভাষা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তিনি স্কুলের হোস্টেলে থাকতেন। স্কুলের গেট ভেঙ্গে রাষ্ট্রভাষা দাবির মিছিলে যোগ দেওয়ার পর স্কুলে ফিরে আসলে তিনিসহ অন্য মেয়েদের স্কুলে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এসময়ে তিনি তার ভাই ভাষা সৈনিক, প্রাবন্ধিক আজিজ মেহেরের সাথে টাঙ্গাইলে মামার বাড়ি ও পরে নিজেদের গ্রামের বাড়ি চলে যান। পরে তিনি ভারতেশ্বরী হোমসে ভর্তি হন কিন্তু সেখানে শৃঙ্খলিত জীবনে থাকতে না পেরে চলে আসেন। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ১৯৫৮ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। দীর্ঘদিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
ভাষা সৈনিক মকবুলা মঞ্জুর পেশাগত জীবনে মুসলিম কমার্শিয়া ব্যাংকে (বর্তমান রূপালী ব্যাংক) অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্ত স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষত হবেন। সেকারণে ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে প্রায় অর্ধেক বেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের মাঠে পতাকা পুততে চাইলে একজন শিক্ষকের বাঁধার মুখে পড়েন। তারপরও তিনি সেখানে পতাকা পুতে দিয়ে বিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি ইউনিভার্সিটি উইমেন্স কলেজ ও সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি প্রায় ২৫ বছর সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার ফিচার সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকার ফিচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ভাষা সৈনিক মকবুলা ১৯৩৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার মুগবেলাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মিজানুর রহমান ও মাতা মাহমুদা খাতুন। বাবা মিজানুর রহমান লেখালেখি করতেন। ৭ ভাই-বোন এর তিন ভাই প্রাবন্ধিক ড. মোখলেসুর রহমান, চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজান, ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক আজিজ মেহের ও তিন বোন জোবেদা খাতুন, অধ্যাপিকা মোসলেমা খাতুন, মুশফিকা আহমেদ। ভাই বোনেরাও লেখালেখির সাথে যুক্ত। কিশোরী বয়সে তিনি নাটকে অভিনয় করতেন। বগুড়া থাকাকালীন তিনি বগুড়া এডওয়ার্ড ঘূর্ণায়মাণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেছেন। এছাড়াও যুক্ত ছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান প্রতিষ্ঠিত মুকুল ফৌজের সাথে।
সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ৮ বছর বয়স থেকে। লিখতেন ছড়া। তার লেখা দৈনিক আজাদে ছাপানো হত। ১৮ বছর থেকে তিনি গদ্য সাহিত্যে অনুরাগী হন। লিখতেন রেডিও টিভির জন্য কথিকা। লিখতেন নাটক। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট, নারীবাদী চেতনা নিয়ে তার কলম ধরেন। তিনি তার লেখা কালের মন্দিরা উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেন।
১৯৬১ সালের ২৯ জুন মনজুর হোসেনের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের আগে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মনজুর হোসেন ছিলেন একজন আইনজীবী। মকবুলার ভাই পরিচালক ইবনে মিজানের সাথে মনজুর হোসেনের পরিবারের পূর্ব পরিচয় ছিল। মকবুলা-মনজুর দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। এই ভাষা সৈনিক ২০২০ সালের ৩ জুলাই ৮১ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন।
গ্রন্থতালিকা: আর এক জীবন (১৯৬৮). অবসন্ন গান (১৯৮২), বৈশাখে শীর্ণ নদী (১৯৮৩). জল রং ছবি (১৯৮৪), আত্মজা ও আমরা (১৯৮৮), পতিত পৃথিবী (১৯৮৯), প্রেম এক সোনালী নদী (১৯৮৯), শিয়রে নিয়ত সূর্য (১৯৮৯, অচেনা নক্ষত্র (১৯৯০), কনে দেখা আলো (১৯৯১, নির্বাচিত প্রেমের উপন্যাস (১৯৯২), নদীতে অন্ধকার (১৯৯৬), লীলা কমল (১৯৯৬), কালের মন্দিরা (১৯৯৭), বাউল বাতাস, ছায়াপথে দেখা, একটাই জীবন, সায়াহ্ন যূথিকা, নক্ষত্রের তলে
পুরস্কার ও সম্মাননা: অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭), উপন্যাসে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০০৫), জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার শ্রেষ্ঠগ্রন্থ পুরস্কার (১৯৯৭)- কালের মন্দিরা, রাজশাহী লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৩), কমর মুশতারী পুরস্কার (১৯৯০)- কথা সাহিত্য, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৪)
সংগ্রহ ও সংকলিত: ইসমাইল হোসেন, তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট।