পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক একটি কৃষি প্রযুক্তি হচ্ছে মালচিং পদ্ধতি। তাই অনেক কৃষক এই পদ্ধতিতে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। দ্বিগুণ ফলন ও ভালো বাজার দরে সবজি বিক্রি করে সিরাজগঞ্জ সদর ও কামারখন্দ উপজেলার অনেক সবজি চাষি লাভবান হয়ে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। অধিক পরিমাণে লাভজনক হওয়ায় দিন দিন মালচিং পেপার পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন সিরাজগঞ্জের কৃষকরা।
বেসরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি)-এর বাস্তবায়নে এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর অর্থায়নে কৃষি ইউনিটের আওতায় ২০২২ সাল থেকে সিরাজগঞ্জ সদর এবং কামারখন্দ উপজেলায় মালচিং পেপার দিয়ে শসা, মরিচ, টমেটো, তরমুজ, করোলা, বেগুন চাষ করে প্রত্যেক কৃষক লাভবান হয়েছেন।
জানা যায়, মালচিং পদ্ধতিতে প্রথমে জমিতে পরিমিত রাসায়নিক ও জৈব সার দিয়ে সারি সারি বেড তৈরি করা হয়। পরে সারিবদ্ধ বেডগুলো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। বেডে নির্দিষ্ট দূরত্বে পলিথিন ফুটো করে সবজির বীজ বা চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের পর শুধু দেখভাল করা ছাড়া তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। মালচিং পেপার দ্বারা ঢেকে দেওয়ার কারণে ছত্রাক বা রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ হয় না বললেই চলে। জমির পরিচর্যার জন্য তেমন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। ফলে উৎপাদন খরচ হয় খুব কম। এই পদ্ধতিতে ফলন হয় দ্বিগুণ। পরিশ্রম কম হয়। এ পদ্ধতি অনেক সহজলভ্য লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব। কামারখন্দ উপজেলার কৃষক শামীম হোসেন বলেন, আমি ২-৩ বছর হলো কৃষির সাথে জড়িত। গতানুগতিক কৃষি কাজে অভ্যস্ত ছিলাম। কৃষির নতুনত্ব প্রযুক্তি ছিল আমার একদম অজানা। যার কারনে প্রতিবছর সবজি চাষ করে খুব একটা লাভের মুখ দেখতে পারিনি। এরই মধ্য বেসরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি) সমন্বিত কৃষি ইউনিটের কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ হলে, জানতে পারলাম নিরাপদ ফসল উৎপাদন এর বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন, মালচিং পেপার, ফেরোমন ফাঁদ, রঙিন আঠালো ফাঁদ সম্পর্কে। এক পর্যায়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সমন্বিত কৃষি ইউনিটের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ঐ এলাকায় নতুন করে মালচিং পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি হিসেবে টমেটো চাষ শুরু করি। এতে তিন মাসের মধ্য ভালো ফলন হওয়ায় সবজি চাষে আরও আগ্রহ বাড়ে তার। কৃষক ৪ মাসের অধিক সময় টমেটো উত্তোলন করি। ২৮ শতাংশ জমিতে মোট ২৮,৫৭০ টাকা খরচ করে মোট বিক্রি করে ১,০৭,৮৮০ টাকা। খরচ বাদে আমার লাভ হয় ৭৯,৩১০ টাকা। আমি বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করলেও ২৮ শতাংশ জমি থেকে এতো লাভের মুখ দেখবে সেটা কখনো ভাবিনি।
তিনি আরও জানান মালচিং পদ্ধতিতে টমেটো চাষের ফলে পোকামাকড়ের আক্রমন কম হয় যার কারনে কৃষকের কীটনাশক প্রয়োগ তেমন প্রয়োজন হয়না। তাই আমার সাফল্য দেখে এই গ্রামের অন্যান্য কৃষক মালচিং পেপার দিয়ে বেগুন, ধুন্দল, মরিচ, টমেটোর আবাদ করে লাভবান হয়েছেন। আগামীতে বেশিরভাগ সবজি চাষ মালচিং পেপার দিয়ে করবেন বলে তিনি জানান।
সদর উপজেলার কৃষক শামসুদ্দিন বলেন, এনডিপির কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে ৪০ শতক জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীল মেসি ও তামিম জাতের শসা চাষ করেন। জমি প্রস্তুত থেকে রোপণ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে চারা রোপণ করার ২১ দিন পর শসার ফলন শুরু হয়। তিন ধাপে জমি থেকে ৩০০ মণ শসা উত্তোলন করে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করেন। এতে লাভ হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আশানুরূপ ফলন ও বাজার দরও ভালো পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, তার এই অভাবনীয় সাফল্য দেখে পাশের গ্রামের কৃষক বাবু মিয়াও মালচিং পদ্ধতিতে ৪০ শতক জমিতে শসা চাষের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে ২০ শতক জমিতে শসার চারা রোপণ করেছেন।
এনডিপি সমন্বিত কৃষি ইউনিটের কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল হালিম জানান, নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও বাজারজাত করনের জন্য সমন্বিত কৃষি ইউনিট (পিকেএসএফ) এর মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষন ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে এনডিপি। যাতে উদ্যোক্তারাও সাবলম্বী হতে পারে। অন্যদিকে ভোক্তাগনের কাছে নিরাপদ সবজি পৌঁছায় এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। যেহেতু মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে কম সময়ে অল্প খরচে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তাই আমরা কৃষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষন ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগীতা করছি। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট চাষির জমিতে যেন পোকামাকড়ের আক্রমণ না হয় সেজন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা হয়েছে।
উপপরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর জানান এ বছর অত্র জেলায় মালচিং পেপারের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মালচিং পেপার ব্যবহারের ফলে সারের এবং পানির অপচয় কম হয়। সার্বিকভাবে কৃষক লাভবন হয়। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কৃষকদের ডিএই প্রশিক্ষন ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগীতা করে থাকে।