তাড়াশসিরাজগঞ্জ

তাড়াশের শতবর্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহমান মিঞা। ১৯২১ সালের ১৩ মার্চে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের ভাদাস গ্রামে তার জন্ম। তার পিতার নাম রায়হান উদ্দীন, মায়ের নাম ওমর জান। অকুতভয় শতবর্ষী এই বীরের জীবনে রয়েছে বহু অর্জন, বেদনাময় দু:খের স্মৃতি ও অপূর্ণতা।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “ তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দবাতে পারবেনা। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ” মূলত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন বলে জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞা।

এক সাক্ষাৎকারে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞা বলেন, তিনি ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ঢাকাস্থ সাভার থেকে ৬ মাসের প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। পরিবারের লোকজন জানতেননা সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি। এ কারণে তাড়াহুড়ো করে তার বিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেনাবাহিনীতে যেতে দেয়নি। এ বছরেই তিনি তৎকালীন মহকুমা সিরাজগঞ্জে আনসারের সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যোদ দেন। ডজনখানেক আনসারের প্রশিক্ষণ রয়েছে তার। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আর্মস কোয়ালিফাইড আনসার ইন্সট্রাক্টর (একিউএআই) খেতাবে  ভূষিত হন তিনি।

এদিকে আনসারে কর্মরত অবস্থায় দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। উত্তর বঙ্গের সূর্য সন্তান তৎকালীন ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে একটি মুক্তি বাহিনী দল গড়ে তোলা হয়। নাম দেওয়া হয় পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবীর।  এখানে মুক্তি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর হিসেবে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞা।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন। পরবর্তীতে যা সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধে রুপ নেয়। পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবীরের মুক্তি বাহিনী গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ রপ্ত করেন। পরে পাক হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে আক্রমণ করে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন। পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবীরে ৪৫০ জন মুক্তি বাহিনী ছিলেন। পরে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আরো ২৫০ জন মুক্তি বাহিনী যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞা বলেন, পশ্চিম সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন জায়গাতে যুদ্ধরত অবস্থায় আমাদের কাছে খবর আসে, একদল পাকবাহিনী তাড়াশের নওগাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। আমরাও প্রস্তত হয়ে পড়ি। ১১ নভেম্বর রাত সারে ৪টা থেকে পরের দিন বেলা ২ টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবীরের অধিনায়ক আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃতে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেইন সেলিমসহ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৭ জন ঊর্দ্ধত্বন কর্মকর্তা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। পাক বাহিনীর ২০০ জনের মত মারা যায়। এ ছাড়াও বেশ কয়েকজন রাজাকার ও আলবদর মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে পাকিস্তানী বাহিনীর বিপুল পরিমাণ ভারী সমরাস্ত্র ও গোলা-বারুদ। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মাত্র ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হন।

তথ্য সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সামাজিক কাজ ও সমাজ বিনির্মানে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞার রয়েছে বিশেষ অবদান। তাড়াশের মাধাইনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নামের তালিকার বোর্ডে এখনো জাতীর এই বীর সন্তানের নাম শোভা পাচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞা ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মাধাইনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই কয়েক বছরে তিনি তাড়াশ-ভূয়াগাঁতী আঞ্চলিক সড়কটি মাটি ফেলে উঁচু করার ব্যবস্থা করেন। বিশেষ করে, চলনবিল অধ্যূষিত তাড়াশের এ সড়কটি বন্যার ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য ১৭ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে ১৬ হাজার ৬৬৩ টি তাল বীজ বপন করেন। এ তাল সড়কের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৈন্দর্য্য দেখতে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন তাড়াশে। তিনি তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, তাড়াশ ডিগ্রি কলেজ, তাড়াশ মহিলা ডিগ্রি কলেজ, তাড়াশ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন।

তিনি তাড়াশ-রায়গঞ্জ আসনে জাসদের মশাল প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছেন। কিন্তু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। বরং বামদল করায় তাকে বারবার জেলে যেতে হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞা একজন শিক্ষকও বটে। তাড়াশের পাশের সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া ইউনিয়নের আয়াশ গ্রামের একটি মাদ্রাসাতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন। তিনি পরম ধর্ম পরায়ণ মানুষ। ১০ বছর বয়স থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ও রোযা রাখতে শুরু করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুুর রহমান মিঞার রয়েছে করুন বেদনা ও কিছু অপূর্ণতা। বিশেষ করে, ১১ বছর বয়সে তার মারা যান। ১৪ বছর বয়সে তার বাবা মারা গেলে এতিম হয়ে পড়েন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জীবন বাঁচাতে তার বাড়ির সবাই পালিয়ে ছিলেন। এরই মধ্যে তার স্ত্রীর প্রসব ব্যথা ওঠে। রাজাকারদের ভয়ে তিনি বাড়ির পাশের জঙ্গলের মধ্যে চলে যান নিরাপদে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। তারপর সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার স্ত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও নবজাতকটি দুধের অভাবে জঙ্গলে পড়ে থেকে মারা যায়। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তাল সড়কের তাল গাছের পাকা তাল খেয়ে লোকজন আটিগুলো দেবেন। তিনি সেগুলো তাড়াশের ৩৬টি সড়কে বপন করবেন। কিন্তু  তার সে স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে।

একান্ত সাক্ষাৎকারে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞার মহানুভবতাও বেড়িয়ে আসে। এখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি বরাদ্দের পাকা বাড়ি পাননি কেন ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অফিসে নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকেছি সব সময়। আগে গরীব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর দিতে গিয়ে আজও আমার নিজের ঘর হয়নি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাড়ানোর উপর গুরত্ব আরোপ করে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কারো তেমন ভাবনা নেই। কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই আমাদের মনে রেখেছেন।

জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মিঞার শিক্ষা জীবনের শুরু তার নিজ গ্রামের ভাদাস প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এ বিদ্যালয়টি ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত। পরে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে গুরুদাসপুর উপজেলার গুরুদাসপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। বিএ পড়লেও নানা কারণে পরিক্ষা দিতে পারেননি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহমান মিঞা শত বর্ষেও চশমা ছাড়াই যে কোন লেখা পড়তে পারেন। বয়সের তুলনা করলে তার শারীরিক অবস্থা বেশ ভালো আছে। তিনি বাড়ি থেকে হেঁটে বাজারে যাওয়া-আসা করেন। প্রত্যহ সকালে চা ষ্টলে বসে লোকজনের সাথে কথা বলেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে, দুই নাতীকে নিয়ে সুখের শেষ নাই তার। এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ-৩ (তাড়াশ, রায়গঞ্জ, সলঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক  ডা. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাংবাদিকদের লেখালেখির উপর গুরুতারোপ করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button