শিক্ষাসাহিত্যসিরাজগঞ্জ

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক মোতাহার হোসেন তালুকদার

ইসমাইল হোসেন: প্রয়াত এই ভাষা সৈনিক মোতাহার হোসেন তালুকদার জন্ম নেন ১৯২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে দূরে নিভৃতপল্লী রতনকান্দি ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামে। পিতা নঈমুদ্দিন তালুকদার।  পেশাগত জীবনে ছিলেন শিক্ষক। সাত বছর বয়সে মা-কে হারান। বারো বছর বয়সে জন্মদাতা পিতাকে হারান।  শিক্ষক পিতার সন্তান মোতাহার হোসেন বাল্যকালে ছিলেন মেধাবি। স্কুল পর্যায়ে মেধাবি ছাত্রের স্বীকৃতি হিসেবে মাইনর পরীক্ষা পাবনা জেলার পাঁচটি বৃত্তির একটি এবং উচ্চ প্রাইমারিতে সিরাজগঞ্জ মহুকুমার চারটি বৃত্তির একটি এবং ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাবনা জিসি ইন্সষ্টিটিউট থেকে বৃত্তি নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন শেষ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে। বিজ্ঞানে স্লাতক ডিগ্রি অর্জন করেন রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে। 

ছাত্র রাজনীতিতে তিনি ১৯৪৪ কুষ্টিয়াতে লিখিল বঙ্গ ছাত্রলীগের কাউন্সিলে যোগ দেন।  কাউন্সিলে ভোট দিলেন শেখ মুজিবকে।

১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নির্বাচনের প্রাক্কালে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব শূন্যতার সৃষ্টি হলে দায়িত্ব কাঁধে নেন জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের। এসময় চষে বেড়িয়েছেন সিরাজগঞ্জ-কাজীপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় মুসলিম লীগের প্রার্থীকে জেতানের জন্য।

ভাষা সৈনিক মোতাহার হোসেন তালুকদার ১৯৪৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হন প্রো-ভিপি। তিনমাস পরে দায়িত্ব গস্খহণ করেন ভারপ্রাপ্ত ভিপি হিসেবে। ছাত্র সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সান্নিধ্যে আসেন তৎকালিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দ্দীর।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে রাজশাহী কলেজ ছাত্রসংসদের প্রো-ভিপি পরে ভারপ্রাপ্ত ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ১৯৪৮ সালে পাবনা ও রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ভাষা সৈনিক জননেতা প্রয়াত মোতাহের হোসেন তালুকদার। 

১৯৪৯ সালে বিএসসি পাস সিরাজগঞ্জে হাজী আহমদ আলী হাই স্কুলের বিএসসি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

প্রয়াত মোতাহার হোসেন তালুকদার এর জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায়,  ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষন করে। শিক্ষক মোতাহার মাষ্টার ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুলে গিয়ে দেখেন ছাত্ররা ক্লাস করছে।  মোতাহার মাস্টার বললেন, ‘ঢাকায় ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আজ ক্লাস হবে না।’  খবর পেয়ে স্কুল কমিটির সভাপতি আব্দুল্লা আল মাহমুদ এমএনএ স্কুলে আসলেন। হেড মাষ্টারকে জিজ্ঞেস করলেন ক্লাসে ছাত্ররা নেই কেন? উত্তরে হেডমাষ্টার জহুরুল হক বললেন, বিএসসি স্যার ছুটি দিয়েছেন। আবদুল্লা আল মাহমুদ শিক্ষক মোতাহার হোসেনকে ডাকলেন, জিজ্ঞেস বললেন মাস্টারি করবে না রাজনীতি করবে। মোতাহার মাষ্টার বললেন রাজনীতি করব।

সেই যে শুরু। আমৃত্য রাজনীতি করেছেন মানুষের জন্য। দেশের জন্য। প্রয়াত এই ভাষা সৈনিককে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ন অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২১ সালে মরণোত্তর একুশে  পদক প্রদান করেন।

১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরাজগঞ্জে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম মহুকুমা কমিটি। আমীর হোসেন উকিল সভাপতি, আজগর আলী মোক্তার সাধারণ সম্পাদক। মোতাহার হোসেন তালুকদার সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন।

১৯৫০ সালে মওলানা ভাসানী জেলে। শেখ মুজিব জেল মুক্ত হয়ে শহিদ সোহরাওয়ার্দ্দীর সাথে আসেন সিরাজগঞ্জে। খাঁন সাহেবের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। জনসভা সফল করতে রাখেন গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা।

১৯৫৪ সালে সিরাজগঞ্জে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী ডা. বশিরউদ্দিনের বিজয়ে গ্রামে গ্রামে নৌকার প্রার্থীর জন্য রাখেন গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা।  ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগ দেন।  ১৯৫৭ সালে সিরাজগঞ্জে উপনির্বাচনে  কাজ করেন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী ডা. জমিস উদ্দিনের পক্ষে।

তিনি ১৯৫৮ সালের সামরিক আইনে দন্ডিত হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ঘোষিত হলে এ অঞ্চলে ৬ দফা দাবিতে জনমত গড়ে তুলতে ভুমিকা রাখেন। ১৯৬৭ সালে সিরাজগঞ্জ কলেজে ছাত্র-শিক্ষক সংঘর্ষে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন। ১৯৬৯ সালে মুসলিম লীগ নেতা মজিদ তালুকদারের বাড়িতে হামলা-তছনছের মামলায় সামরিক আদালতের রায়ে জেল খাটেন।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর কারাগারে বন্দি থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন পাকিস্তানের শেষ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে। তিনি নৌকার প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ-কাজিপুর এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।

প্রয়াত মোতাহার মাষ্টার ছিলেন ১৯৭১ সালে সিরাজগঞ্জ মহুকুমা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি। সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। ওই বছরের এপ্রিল মাসে ভারত গমন। সংগঠিত করেন মুক্তিযুদ্ধ। ১৭ ডিসেম্বর প্রবেশ করেন মুক্ত সিরাজগঞ্জে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদের সদস্য হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রস্তুতিতে ভুমিকা পালন। ১৯৭৩ সালে সোভিযেত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৫ সালের সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বাকশাল পদ্ধতির প্রথম গভর্ণর মনোনীত হন। 

প্রয়াত মোতাহার হোসেন তালুকদার ১৯৪৯ সালে ছিলেন সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালিন সাংগঠনিক সম্পাদক, পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক এবং শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিরাজগঞ্জ জেলার শাখার সভাপতি।

সিরাজগঞ্জের এই কৃতী সন্তান, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, ভাষা সৈনিক মোতাহার হোসেন তালুকদার ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চির বিদায় নেন।

সূত্র: ১.প্রয়াত মোতাহার হোসেন তালুকদার এর জীবনী গ্রন্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button