ইসমাইল হোসেন: আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ভাষার বহমনতার সূচনা হাজার বছর আগে। কিন্ত রাজা, বাদশা আর সম্রাটেরা তাদের নিজেদের শাসন ও শোষনের সুবিধার জন্য এঅঞ্চলের সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয় সাংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষা। সাধারণ মানুষ রাজ বাদশার রক্তচক্ষুকে বিনা বাধায় মেনে নেয়নি। শাসক শ্রেণির সেই রক্ষচক্ষুকে উপেক্ষা করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রিয় মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছে। বিকশিত করেছে। এই দীর্ঘ পথে গ্রহণ, বর্জন, সংযোজন, বিয়োজনের মধ্যদিয়ে মাতৃভাষা বাংলা আজকের অবয়বে এসেছে।
বিকাশের এই দীর্ঘ পদপরিক্রমায় লড়েছেন কবি, লড়েছেন সাহিত্যিক, লড়েছেন শিক্ষাবিদ, লড়েছেন রাজনীতিক এবং সাধারনে। মাতৃভাষার প্রতি দরদ তাইতো দেখি মধ্যযুগের কবি আব্দুল কাদির এর নুরনামা কাব্যে-
যে সবক বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন করি।।
দেশিভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।
নিজদেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতাপিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।।
দেশীভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
তেমনি আব্দুল হাকিম পরবর্তীতে ভাষার প্রতি অনুরাগ দেখা যায় নিধুবাবুদের কাব্যে -নানান দেশে নানান ভাষা। বিনে বিদেশী ভাষা, পুরে কি আশা? মধ্যদিয়ে ব্যক্ত হয়। আবার ‘ভুবন ভ্রমিয়া শেষে’ মাইকেল মধুসুদন দত্ত বললেন, মাতৃভাষা রূপখনি পূর্ণ মণিজলে।
এভাবে কাব্যে, সাহিত্যে বাংলাভাষী কবি লেখকদের অনুরাগ প্রকাশ পায়। এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলা ভাষার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন ব্যপ্তিতে ঘটে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিচর্যার মধ্যদিয়ে তার বিস্তার ও বিকাশ ঘটে।
অন্যদিকে এইদীর্ঘ পথে বাংলা ভাষার প্রতি অবিচার চলে রাজশক্তির। বিশেষ করে ইংরেজ আগমনে এবং ইংরেজ শাসনের নানা পর্বে ইংরেজী প্রতিষ্ঠা ও বাংলাকে অবহেলার চরিত্র হয় প্রকাশিত।
এর বিরুদ্ধে মাতৃভাষাকে রক্ষায় বুদ্ধীজীবী ও সাধারণে লড়াইও ছিল ধারাবাহিক।
এলড়াইয়ের কালপঞ্জিতে সৈয়দ নওয়াব আলী ১৯১১ সালে রংপুরে ভারতের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গুরুত্বের কথা বলে একে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকার করে নেওয়ার আহ্বান জানান।
১৯১৯ সালে বিশ্বভারতির এক সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে মওলানা আকরাম খান বাংলাকে ভারতে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এস হলের সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাকে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উন্থাপিত হয়।
ইংরেজ অবসানে ৪৭ সালে ভারত বর্ষ বিভক্ত হয়। ভুমিষ্ট হয় পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের। মুসলিম জাতিয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেই নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব শুরু করে বাংলার প্রতি অবহেলা। যার প্রকাশ ঘটে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জানের বক্তৃতায়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে লিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়াকিং কমিটির সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান মজলিসে এ ইত্তেহাদুল মোসলেমিনের বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা। এর তিনমাস পরে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেন ভারতে যেমন হিন্দি রাষ্ট্রভাষা পাকিস্তানি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত।
ড. জিয়াউদ্দিনের অভিমতের বিরুদ্ধে ড. শহীদুল্লাহ আজাদ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে প্রদিবাদ করেন।
৪৭ এর ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের তিন মাসের পরে ৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের তদানিন্তন রাজধানী করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলনে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ঘোষণা করেন- ঃড় পৎবধঃব ধহ বষবঃব ঃযধঃ রিষষ ফবঃবৎসরহব ঃযব য়ঁধষরঃু ড়ভ হবি পরারষরুধঃরড়হ.
পরের বছর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে তদানিন্তন কংগ্রেস দলীয় নেতা, গণপরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের ৩য় অধিবেশনে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও পরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
গণপরিষদের পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি সদস্যরা বাংলাকে পরিষদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেন। এই ভোট দেওয়ার খবর ঢাকা এসে র্পৌছালে ঢাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাঙালি মুসলিম সদস্যদের ওই আচরণের প্রতিবাদে ঢাকায় ৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয়। এভাবে শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে বাংলা ভাষার প্রতি রাজদরবারের অবজ্ঞার সঙ্গে যুক্তহয় নব্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র। এর বিরুদ্ধে বাঙালিরা সূচনা করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথের সংগ্রাম।