সিরাজগঞ্জ

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠা করা হয় রেনেসাঁ ক্লাব

ইসমাইল হোসেন: ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্টের জন্ম। দেশভাগের আগের বছর ৪৬ সালে কোলকাতার দাঙ্গার খবর পাবনা ও সিরাজগঞ্জে এসে পৌঁছে। ফলে ৪৭ সালের দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক কারণেই বহু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সিরাজগঞ্জ ছেড়ে ভারত চলে যায়। দেশভাগের আগে যারা সিরাজগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যুক্ত ছিলেন তাদের অধিকাংশ দেশে ছেড়ে চলে যান ওপার বাংলায়।

অন্যদিকে ভারত থেকে মুসলমানরা এসে এশহরে বসতি গড়ে তোলেন। ফলে ৪৭ পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের সময় এশহরে গোড়া মুসলমানদের আধিক্য বেড়ে যায়। সিরাজগঞ্জের সমাজে ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সৃষ্ট হয় শূন্যতার। সৃষ্টি হয় একধরনের সাংস্কৃতিক সংকটের।

এমন পরিবেশেই সংঘটিত হয় ৪৮-৪৯ সালে ভাষা আন্দোলন। ৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের অর্জিত অভিজ্ঞতায় সিরাজগঞ্জে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম অনুভব করেন মিছিল মিটিংয়ের পাশাপাশি উর্দু সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিরোধে আন্দোলন পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা। এপ্রেক্ষিতে তিনি পাকিস্তানিদের উর্দ্দু সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অরাজনৈতিক পরিচয়ে ভাষা সংগ্রামীদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন রেনেসাঁ ক্লাব। শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা করার উদ্দেশ্য নিয়েই ১৯৫০ সালে ভাষা সংগ্রামীরা সে সময়ের মাড়োয়ারী পট্টী আজকের সময়ের মুজিব সড়কে প্রতিষ্ঠা করেন রেনেসাঁ ক্লাব। এক্লাব প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে সিরাজগঞ্জে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জাগরণের সৃষ্টি হয়।

১৯৫০ সালে ছাত্রনেতা সাইফুল ইসলামের প্রস্তাবে মাঠ মাতানো খেলোয়াড় প্রয়াত তমিজুল ইসলাম (জানপুর পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা ছিলেন পরে সাম্যবাদী দলের নেতা এবং ঢাকায় বসতি গড়েন)। এবং সমবয়সী সুবোধ চন্দ্রকে প্রস্তাব দিলেন একটি ক্লাব স্থাপনের। তিনজনের অগ্রনী ভুমিকা ও অন্যদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হলো রেনেসাঁ ক্লাব। পর্যায়ক্রমে এগিয়ে এলেন খোরশেদ আলম, মশিউর রহমান টিংকু (আজিজ মেহের) রামকৃঞ্জ সাহা, সন্তোষ ঘোষ, জুবিলী লেন এর বাসিন্দা পরে বাংলাদেশ রেতার এর পরিচালক, নুরুন্নবী খান পুতুল, সুর্য কুমার দে, সন্তোষ ঘোষ, শান্তি রঞ্জন তালুকদার, রামনারায়ন সারদা, মুরারী সারদা প্রমুখ। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হলেন  মোশাররফ হোসেন মাষ্টাারের মেয়ে ভাষা সৈনিক ইর্,া সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালিন সভাপতি আমির হোসেন উকিল এর মেয়ে ভাষা সৈনিক হেনা, শামসুজ্জোহা উকিল এর মেয়ে ভাষা সৈনিক বিজলী।

ক্লাব এর ভুমি

ক্লাব এর ভুমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা করেন দলিল লেখক ফকির চান (বিরোজ প্রেস, কালিবাড়ি)। ক্লাবের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন পাবনার বারের আইনজীবী শহিদ এম. মনসুর আলী। শহিদ এম. মনসুর আলী ক্লাব উদ্যোক্তাদের প্রস্তাব দেন আপোষ নিষ্পত্তির। প্রস্তাবে সম্মত হন ক্লাব উদ্যোক্তাগন। শেষে ১ হাজার ৩ শত টাকায় মধ্যস্থতা হয়। ক্লাব এর টাকার যোগান দেন যুবক ব্যবসায়ী ক্লাব প্রতিষ্ঠাতা পাঠাগার সম্পাদক  ২নং খলিফাপট্টীর গৌর সাহা। সমাধান হয় ভুমির জটিলতা। সেই থেকে নিজস্ব ভুমির ওপর দাঁড়িয়ে গেল রেনেসাঁ ক্লাব। বিষয়টি হয়ত ভুমি দফতওে আপডেট না থাকায় পরবর্তীতে পুনরায় পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে  বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিম মুক্তা পুর্বতন কাগজপত্র সংগ্রহ করে প্রমাণাদি দাখিল করে। এর মধ্যদিয়ে  নিষ্কন্টক হয়ে সিরাজগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র রেনেসা ক্লাব এর ভুমি।

ক্লাব এর নামকরণ:

রেনেসাঁ ক্লাব এর নাম প্রস্তাব করেছিলেন সিরাজগঞ্জ কলেজ এর তৎকালিন শিক্ষক এহিয়া খান। এহিয়া খান পরবর্তীতে রেডিও পাকিস্তানের মহাপরিচালক ছিলেন। এপ্রসঙ্গে শহরের জুবিলী বাগান লেন এর বাসিন্দা, এহিয়া খান এর ছোটভাই নুরুন্নবী খান এক সাক্ষাৎকার বলেন,

রেনেসাঁ ক্লাব এর নামকরণ করেছিলেন আমার ভাই এহিয়া খান। তিনি সিরাজগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করতেন বলে ক্লাব এর সেক্রেটারি হতে রাজি হননি, সেক্রেটারি হন ডা. সাহেব আলী।

গৌতম সাহা লিখিত গৌরসাাহার সাক্ষাৎকারভিত্তিক নিবন্ধ থেকে জানা যায় ক্লাব প্রথম সভাপতির ছিলেন প্রয়াত রামনারায়ন সারদা।

ক্লাব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার সাক্ষাৎকারে নুরুন্নবি খান আরও জানান,

১৯৫০ সালে সিরাজগঞ্জের মাড়োয়ারী পট্টীতে গড়ে ওঠে রেনেসাঁ ক্লাব। এটি ছিল অরাজনৈতিক সংগঠন। খেলাধুলা, সংগঠন চর্চ্চা, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী পালন, নববর্ষ উদযাপনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হত এই সংগঠনের মাধ্যমে। ক্যারাম, ব্যাডমিন্টন, পিংপং প্রভৃতি খেলা হত। তাসখেলা নিষিদ্ধ ছিল এই ক্লাব। শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা করাই ছিল ক্লাব প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য।

মুলত ৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে ভাষা সৈনিকরা মুখোমুখি হন উর্দু ভাষীর চক্রের। ওই সময়ে সিরাজগঞ্জে প্রদর্শিত উর্দু চলচ্চিত্র ও উর্দু গানের প্রচারণার মাত্রা বেড়ে যায়। এই সময়েই শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা লক্ষে উর্দু গানের প্রচারনার বিরুদ্ধে বাংলা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার পরিকল্পনা থেকেই এই ক্লাব এর প্রতিষ্ঠা করেন সিরাজগঞ্জের ভাষা সৈনিকরা। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে বিশেষ করে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সিরাজগঞ্জের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল এই ক্লাব। বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহ্নত হয় এই রেনেসা ক্লাব। রেনেসা ক্লাব হয়ে ওঠে সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। এখানে নিয়মিত উপস্থিত ঘটত ভাষা আন্দোলনের নেতা কর্মীদের।

এম. আব্দুল আলীমের সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন গ্রন্থ থেকে জানা যায়,

এই সড়কের রেনেসাঁ ক্লাব ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। এখানে নিয়মিত বিচরণ ঘটত ভাষা আন্দোলনের নেতা কর্মীদের। ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ কর্মসূচি, সভা-সমাবেশের সূত্রপাত ঘটত এই সড়ক থেকে। ভাষা আন্দোলনের সময় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই শ্লোগানসহ নিয়মিত শোভাযাত্রা বের করত ছাত্র-জনতা। পুলিশের লাঠিচার্জে এখানকার বহু মিছিল পন্ড হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

এর সত্যতা পাওয়া যায় ভাষা সৈনিক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আনোয়ার হোসেন রতু’র সাক্ষাৎকারে

১৮ জানুয়ারি গোপনে মিটিং হয় শহরের বাজার রোডে আলমগীর ভায়ের বাসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমি (্আনোয়ার হোসেন রতু), সাইফুল ইসলাম, আজিজ মেহের, তমিজুল ইসলাম, আব্দুল মমিন চাল্লি, আব্দুর রশিদ নান্নু প্রমুখ। এই মিটিংটি অসম্পুর্ন অবস্থ্ায় শেষ হয় আই, বি’র লোকদের উপস্থিতির ফলে। এর তিনদিন পর আরেকটি মিটিং হয় মাড়োয়ারী পট্টী রেনেসাঁ ক্লাবে। সেখানে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

এভাবেই শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার আদলে মূলত সিরাজগঞ্জের ভাষা সৈনিকদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রেনেসাঁ ক্লাব বাঙালি জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ঠাই করে নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে মারোয়ারী পট্টীতে স্থাপিত রেনেসাঁ ক্লাব হয়ে ওঠেছে ইতিহাসে ঐতিহ্য।

শুধু ভাষা আন্দোলন নয়। ভাষা আন্দোলন ও  বাঙালি জাতিসত্ত্¦ার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এমনকি মুক্তিযুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রেনেসাঁ ক্লাব রাখে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা। সিরাজগঞ্জের এই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্রীড়া সংস্থা রেনেসা ক্লাব সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য। সিরাজগঞ্জ বাসীর গৌরবের অংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button