তাড়াশরায়গঞ্জসদরসিরাজগঞ্জ

মুক্তিযুদ্ধে হান্ডিয়াল যুদ্ধের নায়ক জননেতা লতিফ মির্জার ১৬তম প্রয়াণ দিবস

বাঙালি জাতির হাজার বছরের অন্যতম গৌরবের সাল ১৯৭১। পৌনে দুশত বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও বৃটিশ শাসক গোষ্ঠির গোলামীর বিরুদ্ধে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, ছিনকে লেঙ্গে পাকিস্তান শ্লোগানের সাথে ঐক্যমত হয়ে এ অঞ্চলের বাঙালিরা সাধের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ভুমিকা রাখে। ৪৭ এর ভারত বিভক্তির মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রভুমিতে বছর না ঘুরতে পশ্চিমা পাঞ্জাবিরা ঘৃণ্য আঘাত হানে বাঙালির ওপর। বাঙালি ছাত্রজনতার সাথে এঅঞ্চলের বাঙালি শ্রমজীবীরা শ্লোগান তোলে ইয়া আজাদি ঝুটা হায়, লাখে ইনসান ভুখা হায়।

সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একবছরের মধ্যেই শুরু হয় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বাঙালি ছাত্র সমাজের সাথে টেকনাথ থেকে পাথুরিয়ার বাঙালী সাধারণ জনগোষ্ঠি শ্লোগান তোলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চায়। সংঘটিত হয় ৪৮-৫২ সালের রাজপথের আন্দোলন। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ২৩ বছর পাকিস্তানি শাষন শোষনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রাম শেষে সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুর এবাবের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- শ্লোগানে উদিপ্ত, তেজোদীপ্ত হয়ে দীর্ঘ ৯ মাস আপামর বাঙালি জনতা সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রভুমি বাংলাদেশ।

উত্তর বাংলার দ্বারপ্রান্তের শহর সিরাজগঞ্জে পাকিস্তানি অন্যায় আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াকু সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের পতাকা ৬০  এর দশকের শুরুর দিকে সমবেত হয় উল্লাপাড়ার নিভৃত পল্লী বংকিরাটের সন্তান আব্দুল লতিফ মির্জা। ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া লতিফ মির্জা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেন নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ (তখনকার সিরাজগঞ্জ কলেজে) থেকে। ছাত্র জীবনেই নেতৃত্ব দেন মহকুমা ছাত্রলীগের, নির্বাচিত হন সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদে। নেতৃত্ব দেন  অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান বিরোধী আন্দোলনে। বহিস্কৃত হন কলেজ থেকে। তবু থেমে থাকনি এ লড়াকু যোদ্ধা।

কলেজ এর সমস্যার পাশাপাশি এ অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা, ছাত্রসংগ্রামৃ পরিষদের ১১ আন্দোলন, উনসত্তরের গণআন্দোলন ও গণঅভ্যন্থান, ৭০ এর নির্বাচন সর্বপরি ৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন উত্তরাঞ্চলের একমাত্র বেসরকারি গেরিলা বাহিনী পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের। পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের পরিচালক এর দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজ মেধা ও সহযোদ্ধাদের আন্তরিকতায় এ বাহিনীকে প্রতিষ্ঠা করেন দেশের অন্যতম বৃহৎ গেরিলা বাহিনীতে। বেদের বহরের মতো গেরিলা যুদ্ধেও অভিনব পন্থায় সংঘটিত পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরকে নেতৃত্ব দেন গোটা চলনবিল এলাকায়। সংঘটিত করেন একের পর এক গেরিলা যুদ্ধ।

সবশেষে ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর তাড়াশের নওগা ইউনিয়নের হান্ডিয়ালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত করে এক মরণপন যুদ্ধ। যুদ্ধে পাকিস্তানি ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একদিনের যুদ্ধ জয়ে এ এক অনন্য রেকর্ড।

এদিন তাড়াশের জনতাকে সঙ্গে নিয়ে তার পরিচালনায় পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবির পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে বেসরকারি বাহিনীর পরিচালনায় বিজয়ের এক অনন্য ইতিহাস আজও জাতিকে সকল অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রেরণাশক্তি যোগায়।

লতিফ মির্জা স্বাধীনতার পর জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এম. মনসুর আলীর নিকট অস্ত্র জমা দিয়ে যুক্ত হন জাতীয় রাজনীতিতে। দায়িত্ব নেন সিরাজগঞ্জ জেলা জাসদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে, পরে দায়িত্ব পালন করেন সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে।  গত শতাব্দীর ৯০ এর  দশকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যয়ন করে তিনি যোগ দেন বাকশালে এবং শেষে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির।

জনতার লতিফ মির্জ্জা উল্লাপাড়া থেকে ১৯৭৯ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মশাল প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।  সংসদে ছিলেন জনতার সমস্যার সমাধানে অবিরত সোচ্চার।

জননেতা লতিফ মির্জা ১৯৮৬ ও ৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে পুনরায় নির্বাচিত হন জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে। ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। তার অকাল প্রয়াণে অগুণিত সাধারণ জনতা হয় শোকাহত। আজ সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জার ১৬তম প্রয়াণ দিবস। প্রয়াণ দিবসে জানাই  সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা বীরমুক্তিযোদ্ধা জনতার লতিফ মির্জা তোমায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button