ইসমাইল হোসেন: গত ১৭ এপ্রিল রমযানের সিয়াম সাধনার শেষ দিকে সবাই ঈদুল ফিতর এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমিও আমার আর্থিক সীমবদ্ধতার মাঝে চেষ্টা করছি ঈদ উদযাপনের। এর মাঝে এফবিতে চোখ পড়ল একটি ছবির ওপর। বয়োবৃদ্ধ একজনের ছবি। চেনা চেনা কিন্ত আবার অচেনা। ছবিতে দৃষ্টি নিবন্ধ করে এবং ছবির ক্যাপশন পড়ে কেমন যেন হয়ে গেলাম। এ-তো আমাদের প্রিয় শিক্ষক লুৎফর রহমান স্যারের।
মনটা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। অনুভব করলাম কিছুটা অস্থিরতা কাজ করছে মনের ভিতর। পত্রিকার সব কাজ থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নিলাম। মন চলে গেল অতীতে-৫২ বছর আগে।
আমার পৈত্রিক বাসা শহরের বাহিরগোলা সড়কে। এশহরের আর একজন স্বনামধন্য বাসিন্দা ছিলেন প্রয়াত ইসরাইল হোসেন ঠিকাদার। তার বাসার সামনে নতুন বইয়ের দোকানের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। দোকানের নাম শিরিন বইঘর। নতুন অথচ বইয়ের গাদাগাদি অবস্থান দোকানটিতে।
এমনিতেই বইয়ের প্রতি একটি লোভ সেই শৈশব থেকে। তদুপরি নতুন বই দেখলেই হাতে তুলে নিতে মন চায়। কিন্ত ওই দোকানে ঠুকতে সাহস হতো না। কারণ দোকানের মালিক রাসভারী চেহারায় লুৎফর স্যার।
পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ কলেজে যখন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম তখন সেই রাসভারী লুৎফর স্যার দিনে দিনে হয়ে উঠলেন আমার প্রিয় শিক্ষকের একজন।
কলেজ জীবনেই ক্লাশে অবসরে কিংবা বইয়ের দোকানে কথা বলেছি অনেক দিন। মূলত স্যার কথা বলেছেন আমি শুনেছি। হাতের আঙুলের ফাঁকে ধুমায়িত সিগারেট, সামনে চায়ের কাপ, মুখে বিরামহীন কথা। এভাবেই জানলাম স্যারের জীবনের অনেক কথা।
এই কথার মাঝেই জানা হয়ে গেল স্যার আমাদের বোন জামাই। জানলাম স্যার বিয়ে করেছেন আমাদের মহল্লার বন্ধু আইয়ুব খান, বড় ভাই মুসা ভাই এবং (পরে জাতীয় পর্যায়ের ফুটবলার) ইলি ভায়ের বড় বোন মাহমুদা শিরিন আপাকে। সেই হিসেবে স্যার হয়ে গেলেন আমার দুলা ভাই।
পট্টীর বোন জামাই আমাদের স্যার। হয়ে গেলাম শালা দুলাভাই। এসম্পর্কই ধীরে ধীরে স্যারের কাছে টেনে নিল সেদিনের কলেজ শিক্ষার্থী ইসমাইলকে।
কথায় কথায় স্যারের মুখেই জেনেছি স্যার পৃথিবীতে এসেছিলেন নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার নিভৃত পল্লী খাঁকড়াদহ গ্রামে। পিতা প্রয়াত সোহরাব হোসেন তালুকদার। জন্মদাত্রী মা- প্রয়াত লাইলী বেগম।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু গ্রামেরই কোন এক বিদ্যালয়ে। ম্যাট্রিক পাশ করেন চাঁচকৈড় নাজিমুদ্দিন হাইস্কুল থেকে। নাটোর এন এস কলেজ ও পাবনার এ্যাডওয়ার্ড কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্নের মধ্যদিয়ে সমাপ্তি ঘটে শিক্ষা জীবনের।
একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম এত কলেজ পরিবর্তনের হেতু কি? জেনেছিলাম ছাত্রলীগের রাজনীতে সক্রিয়তার কারণেই তাকে শিক্ষাজীবনে একাধিক কলেজ পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ৭০ এর দশকের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজে ছাত্রলীগের মনোনীত ভিপি প্রার্থী। নির্বাচনে জিততে জিততে হেরে গেছেন ব্যক্তিজীবনের এক আবেগীয় ঘটনার কারণে।
শিক্ষা জীবন শেষে পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসে (সিএসপি) ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েও যোগ দেননি বাঙালি জাতিয়তাবাদী রাজনীতির মোহে। রাজনীতির কারণেই প্রচন্ড লোভনীয় সে পেশা তাকে আকর্ষিত করেনি।
সিএসপিতে যোগ না দিয়ে তিনি আসলেন সিরাজগঞ্জে। যোগ দিলেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সিরাজগঞ্জ কলেজে অর্থনীতি বিভাগে। সময় টা ছিল ১৯৬৬। দেশটা ছিল পাকিস্তান। সেই যে শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা পেশা প্রচুর আর্থিক অনটনেও স্যারকে ভিন্ন পেশা আকর্ষিত করেনি। একটানা ৩২ বছর পার করলেন শিক্ষকতা পেশায়।
দীর্ঘ এই পেশাগত জীবনে স্যার ছিলেন সিরাজগঞ্জ কলেজ শিক্ষক সমিতির সম্পাদক। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ বে-সরকারি শিক্ষক ফেডারেশন সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের। নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষক ফেডারেশনের বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে।
নিজ গুণে তিনি ছিলেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যায়ের লেখক। অর্থনীতির জটির তত্ব সহজ করে লিখেছিলেন- উচ্চ মাধ্যমিক অর্থনীতি পরিচিতি নামের গ্রন্থে।
শিক্ষকতার পেশায় থেকে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করতে, জীবন বাঁচাতে শিক্ষকতার পাশাপাশি বেছে নিয়েছিলেন বইয়ের সাথে বসবাসের। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিরীন বইঘর নামের পুস্তক ব্যবসার দোকানটি।
রাজনৈতিক চেতনায় তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনার ধারক। পদ পদবি মোহ তাকে আকৃষ্ট করেনি। যেকারণে গুরুদাসপুরে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব তিনি নাকোচ কওে দিয়েছিলেন খুবই সহজ করে। আসলে তিনি ছিলেন শিক্ষকতা পেশার এক নিবেদিত প্রাণ। এই মহান শিক্ষক ছিলেন ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক।
জীবন সংগ্রামী এই শিক্ষক জীবনের ছেদ ঘটিয়ে গত ১৭ এপ্রিল, সোমবার, পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। পৃথিবীতে রেখে গেলেন পাঁচ কন্যাকে। সেদিন রাতেই নামাযে জানাযা শেষে গুরুদাসপুরের জন্ম নেওয়া স্যারকে সিরাজগঞ্জে স্থিতু হওয়ার শহরের পৌর রহমতগঞ্জ কবরস্থানে চিরদিনের জন্য শায়িত করা হলো।
সারা জীবন মানুষ গড়লেন যে মানুষ, সেই মানুষটি অনেকটা নিরবে নিভৃতে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। অগুনিত ছাত্র ও শুভাকাঙ্খিদের চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন আমার স্যার লুৎফর রহমান। ক্ষমা করবেন স্যার, আপনার শেষ বিদায়ের শেষ মোনাজাতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারেন নাই। আমিও ভুলো মনের কারণে আমিও অংশ নিতে পারিনি। সেজন্য হ্রদয় গভীরে সৃষ্ট হয়েছে ক্ষত। ক্ষত হ্রদয়ে দোয়া করি, স্যার ওপারে ভালো থাকুন।