আবুল ইসলাম শিকদার
সমালোচনা ভালো। সমালোচনা মানে নিন্দা নয়। সমালোচনা মানে ভালো মন্দ বিবেচনা করা। এপাশ ওপাশ হতে দেখা।উপর থেকে দেখা। নিচ থেকে দেখা। গন্ধ শুকে দেখা। বাজিয়ে দেখা।
তুলোধুনো করা।
ধুনকার তুলা ধুনে সব তুলা ফেলে দেবার জন্য নয়। তুলার আঁশের জটলা ছাড়াবার জন্য। তুলার ভেতর লুকিয়ে থাকা ময়লা ঝেড়ে ফেলার জন্য।
বুঝে শুনে সমালোচনা করলে সমালোচিত বিষয়টি পরিপাটি হয়। না বুঝে সমালোচনা অবধারিত ভাবে নিন্দায় পরিণত হয়।
নিন্দা কখনো শুদ্ধতার উপায় হতে পারে না। সমালোচনা শেখায় পরিবর্তন সাপেক্ষে গ্রহণ করতে। নিন্দা শেখায় পরিত্যাগ করতে।শেখায় বাঁধাগ্রস্থ করতে।শেখায় যুক্তিহীন বিরোধিতা করতে।
বাংলাদেশের নতুন শিক্ষা নিয়ে তুলকালাম কান্ড হয়ে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে আমার নিজের ধারণার সীমাবদ্ধতা অনেক।তবে একেবারে অজ্ঞতায় ডুবে নেই।
শিক্ষা কেবল পাঠদান আর পাঠগ্রহণের বিষয় নয়। আত্মস্থ করা, ধাতস্থ করা, শরীর মনের সাথে মিশিয়ে দেয়াই হচ্ছে শিক্ষা। বাতাস অনুভব করাই শিক্ষা নয়। বাতাসের উপাদানগুলোকে পরীক্ষাগারে কানে ধরে আলাদা আলাদা চিহ্নিত করাই শিক্ষা।
কবিতা মুখস্থ করাই শিক্ষা নয়। কবিতার বিষয়বস্তু ,কবিতার কবিকে জানা,কবিতার সময় কালের সমাজকে অনুধাবন করাই শিক্ষা।
আমাদের শিক্ষার পুরোটাই ছিল একসময়ে প্রায় বায়বীয়। বইয়ের পাতা আর শিক্ষার্থীর মাথা। এই দুই জায়গায় ছিল শিক্ষার বসবাস। বৃক্ষ তখন শাখা দুলাতো পুস্তকের পৃষ্ঠায়, কোকিলের গান, নদীর কলতান, বৈশাখের তাপদাহ, শীতের সকাল সবই ছিল পুস্তক সর্বস্ব।
যেই বইয়ের পাতা থেকে শিশুকে কোকিল দেখাতে চাইলো, অমনি গন্ডগোল বাঁধলো। নদীর কলকল ধ্বনী নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে শোনাতে পারলে তা নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। যদি ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলানোর দৃশ্য দেখানোর জন্য শিক্ষার্থীদের খেতের আলে দাড় করিয়ে দেয়া হয় তাহলে অসুবিধা কি?
শিক্ষার্থী ডিম ভাজলে অসুবিধা কি? রাধবে ,চুলও বাঁধবে। আমরা শিক্ষিত হলে কি রান্নাবান্না করে খেতে হবে না? বলবেন আগে কি মানুষ খায় নাই? খেয়েছে। কিন্তু খাওয়া আর শ্রমের মর্যাদা শেখা এক কথা নয়। একা বাসায় রান্না করা আর স্কুলে মাসে একদিন বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করে রান্না করা এক কথা নয়।
মানুষ একা খায় উদরপুর্তির জন্য। সকলে মিলে খায় আনন্দের জন্য। আমাদের সমাজের একজন হবু ডাক্তার ইন্জিনিয়ারের জীবনে কোন আনন্দ নেই। সে যাবে কোচিং সেন্টারে।সে কিনবে নোট, গাইড।সে ফালতু গল্প করবে না, হাসবে না, কাঁদবে না। সে হবে রুবোট সদৃশ্য একজন মানুষ।
মানুষের দিকে যার তাকাবার সময় নেই সে কি করে পেশাগত জীবনে মানবিক হবে? আমার তো মনে হয় একজন ডাক্তারের কষে অর্থনীতি পড়া উচিত। তাহলে একজন দিনমজুর সামান্য জ্বরের রোগীকে একগাদা টেস্ট দিয়ে বসবে না। সে কোথায় এতো টাকা পাবে, সে চিন্তা ডাক্তারের নয়।
পঞ্চাশ বছর আগে এক ডাক্তার দশ টাকা ভিজিট নিতেন। তিনি ছিলেন ডাকসাইটে নামকরা ডাক্তার। আমি কলেজের ছাত্র বিবেচনায় তিনি পাঁচ টাকা নিলেন। আমি এখনো তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এটাই শিক্ষা। আমার কাছ থেকে কম নিলো বলে নয়। একজন ছাত্রের প্রতি মানবিক দরদের জন্য।
শিক্ষায় ব্যবহারিকের কোন বিকল্প নেই। আর শিক্ষার পরিবেশ হবে আনন্দদায়ক , উৎসবমুখর। এমনকি দর্শনের মতো উচ্চমার্গীয় শিক্ষায়ও চাই ব্যবহারিক জ্ঞান। যেটি সক্রেটিস করতেন।কোন বিষয়ে তিনি রাস্তা ঘাটে মানুষকে প্রশ্ন করতেন, উত্তর গ্রহণ করতেন, যুক্তি দিয়ে তর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতেন।
মানুষ বড় হয়ে ডাক্তার হবে, ইন্জিনিয়ার হবে, শিক্ষক , সাংবাদিক, উকিল মোক্তার, জজ ব্যারিস্টার হবে, কৃষক ,ব্যবসায়ী , মুদি দোকানদার হবে সেটি খ্বুই স্বাভাবিক। হোক না। অসুবিধা কি? কিন্তু শিশু কিশোর বয়সে একটু বাস্তবতা ছুঁয়ে যাক না। সারাজীবন সেটি তাঁর কাজে লাগবে।
আমি তো মনে করি, আজকের পাঠ্যক্রমে , মাদকের উপর একটি চ্যাপ্টার , ঘুষ দুর্নীতি, বাল্যবিবাহ , মিথ্যাচার এগুলোর উপরও দু একটি করে চ্যাপ্টার থাকা বাঞ্ছনীয়। হয়তো আছেও। এমনকি মোবাইল সার্ভিসিং এর উপরও অধ্যায় থাকা জরুরি। আজকের দিনের সমস্যা যদি আজকের পাঠ্যক্রমে প্রতিফলিত না হয় তবে তা হবে এক কল্পনাবিলাসী , সেকেলে অকাজের শিক্ষা।
বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য চাই বিশ্বমানের বাস্তব জ্ঞান।
সেই বাস্তব জ্ঞান শিক্ষার বয়স হচ্ছে শিশুকাল। ধানের চারা রোপন করি আমরা কাদা মাটিতে। শুকনো খরখরে মাটিতে নয়।
শিশু হোক না, হাস পাখি বাঘ হরিণ, হাতি ঘোড়া। হাসাহাসি করুক, আনন্দ করুক। তাকে নিয়ে যান, পাহাড়ে, সাগরে , জঙ্গলে। দেখুক প্রকৃতি, চিনুক দেশকে, জানুক মানুষকে।
ঘুষ দুর্নীতি , মাদক ,বাল্য বিবাহ , অপসংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ছোট ছোট নাটক, নাটিকা তৈরি করে তারা স্কুল মঞ্চে অভিনয় করুক। এগুলোর পরিণতি তারা মঞ্চে দেখিয়ে দিক। প্রতিযোগিতা হোক এসব বিষয়ে। সচেতন জনগোষ্ঠী তৈরি করাই হোক শিক্ষার প্রধান উৎস।
চিকিৎসা , বৈদ্যুতিক সমস্যা, ঘর সাজানো, মেহমান আপ্যায়ন এগুলোর প্রাথমিক ধারণা সিলেবাসে থাকলে অসুবিধা কি? বরং তাতে আমরা ভবিষ্যতে পাবো চোখ কান খোলা নাগরিক সমাজ।
সবকিছু বাদ দিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে শুধু ডাক্তার ইন্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার বানানোর অন্ধ, অস্থির , অনৈতিক এবং একপেশে অশুভ প্রতিযোগিতার জন্য শিক্ষা নয়। আসুন আমরা চিন্তা করতে শিখি। শরীরের জন্য যেমন সুষম খাদ্যের প্রয়োজন , তেমনি সচেতন, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক মানবিক নাগরিক তৈরির জন্য শিক্ষায় বাস্তবসম্মত বারো রকম মসলা মেশাতেই হবে। কারণ গাছের সার দিতে হয় গোড়ায়। পাতায় মাঝে মাঝে পোকা দমনের ওষুধ ছিটালেই যথেষ্ট। আসুন,শিক্ষার্থীর ছোট বয়সে অর্থাৎ গোড়ায় জল সিঞ্চন করি, তাকে শাখা প্রশাখায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেই। (চলবে)