জাতীয়শিক্ষাসদরসাহিত্যসিরাজগঞ্জ

একজন মনোয়ারুল হক। প্রিয় রাবিয়ান।

আপন এহসান: ১ম দেখা – সম্ভবত ২০১৭ সালের কোন একটি মাস। হঠাৎ জানতে পারলাম ঢাকার বসুন্ধরা কনভেনশন হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মিলন মেলা হচ্ছে। মাত্র আর কয়েকদিন আছে। রেজিস্ট্রেশন সম্ভবত ১০০ টাকা। প্রথমে তাজ্জব লাগলো। এই পাগলের কাজ কারা করছে। আমরা যাঁরা বিভিন্ন ইভেন্ট অর্গানাইজ করি প্রায় প্রতি মাসে (পেশা হিসাবে জানি এটা কত ব্যায়বহুল এবং ঝুঁকি পূর্ণ একটি কাজ)। খুব ইচ্ছা হলো বড় পাগলটিকে দেখার। (রেজিস্ট্রেশন কী করে করলাম সে আর এক কাহিনী এবং এখানে প্রাসঙ্গিকও নয়।) তো জানতে পারলাম তাঁরা প্রায়ই ঢাকা ক্লাবে এখন মিটিং করে। সেখানে গেলাম, দূর থেকে তাঁকে দেখলাম। কিন্তু পরিচয় হলোনা। কেননা আমার দেবার মত কোন পরিচয় ছিলোনা যার জন্য কেউ আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় করাবেন । আমি ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র।

রাবিয়ান ৩৩। (তখনো আমি বিশেষ কেউ ছিলাম না, এখনো আমি বিশেষ কেউ হতে পারিনি। তবে আমার সৌভাগ্য এই যে তখনো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন এবং আমাদের প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ আমাকে চিনতেন, এখনো বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সহ আমার প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ যারা আছেন তাদের অনেকেই আমাকে চেনেন, আমাকে চেনেন আমার অনেক প্রিয় অগ্রজ ও অনুজ ভাই বোনেরা । আমার ধারণা তারা আমাকে চেনেন আমার কাজের জন্য, আমার শ্রমের জন্য, আমার স্পষ্ট যুক্তিযুক্ত অপ্রিয় সত্য কথার জন্য ।)

দেখলাম একজন হক ভাইকে, মনোয়ারুল হক বসে আছেন, যাঁকে ঘিরে নানা সময়ের এবং আমার সময়ের অনেক বড়ো ভাইরা নানান কথা বলছেন। তিনি একে তাকে ধমক দিয়ে এটা ওটা বলছেন কিন্তু কেউ তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছেনা। বুঝলাম মানুষটার কিছুতো একটা আছে।

পরিচয় –

বসুন্ধরা কনভেনশন হলে নির্ধারিত দিন একটু পরেই গেলাম। হাজারো মানুষ হবে সেই ভয় ছিলো। তবুও আমাদের কতজনের সাথে দেখা হবে, প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ আসবেন। একটু কুশল বিনিময় হবে সেই লোভে পৌঁছে গেলাম। যেয়ে দেখি সেই মানুষটি আজ দাঁড়ানো এবং হাতে মাইক্রোফোন। লম্বা দেহ মানুষটি অনায়াসে একেকজন শিক্ষক সম্পর্কে নানা রকম বিশেষণ দিচ্ছেন, নাম বলছেন এবং মাইক নিয়ে পাশে যেয়ে তাঁকে অনুরোধ করছেন কিছু বলার। অবাক ও মুগ্ধ দুটোই হলাম। কেননা এই কাজটি ভয়ানক কঠিন একটা কাজ। শিক্ষকবৃন্দও স্নেহভরে তাঁর নাম নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন। পরে জানতে পেরেছি আমাদের সকল শিক্ষককে প্লেনে করে ঢাকা এনে আরামদায়ক হোটেলে রেখে এই আয়োজনটি তিনি করেছিলেন, যেন তাঁদের একটুও কষ্ট না হয় ।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় যখন এলো তখন দেখা গেলো যিনি সেই কাজটি করার কথা তিনি হয়তো ঠিকমত পারছেন না অথবা হক ভাইয়ের মনের মত হচ্ছেনা। সেই সময় হয়তো তাঁর কাছে কেউ একজন আমার নাম বলেছিলো। আমাকে তাঁর কাছে নেয়া হলো আর তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ গলায় বললেন “কী নাম তোমার, পারবে?” । হয়তো পেরেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে ডেকে বললেন ‘হাসান আজিজুল হক স্যার তোমাকে চেনেন দেখলাম। তিনি বলেছেন তোমার সাথে যাবেন। তুমি যত্ন নিয়ে পৌঁছে দিও। আর একদিন বাসায় এসো কথা হবে’। এই আহ্বানে একটা স্নেহ মেশানো ছিল। বুঝলাম মানুষটার কিছুতো একটা আছে।

বই আর বই –

তারপর অনেক সময় গেছে তাঁর সাথে । অনেক বার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া। গুণীজন সংবর্ধনা দেয়া । আইন বিভাগের যাঁরা বিসিএস ক্যাডারএ অনেক ভালো করেছে তাঁদের কে ডেকে এনে উপহার তুলে দেয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গুণীজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে সংবর্ধনা দেয়া, ঢাকায় বারংবার ডেকে বসিয়েছেন কী কী করা যাবে এলামনাই নিয়ে সেসব ভাবতে। ভিসি সহ অন্যদের সাথে কথা বলে যখন ফ্লাইটে ফিরবো, তিনি থামিয়েছেন। ‘জুলফিকার মতিনের একটা সাক্ষাৎকার ভিডিও করে তারপর চলো গাড়িতে ফিরি। তোমারতো ঢাকা ফেরা দরকার। টিকেট নষ্ট হবে হোক।’ প্রায় সারারাত গাড়িতে গল্প করতে করতে এসেছি। তখনো বার বার একই কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক ও ছাত্রদের যত বই বেরিয়েছে সব ডিজিটাইজ করতে হবে। আগামী প্রজন্ম ছাপা বই খুঁজে পাবেনা কিন্তু আমাদের রাবিয়ানদের সম্পদ তাঁদের জানা দরকার। কিছুটা শুরুও করেছিলেন। বাসায় গেলেই কোন একটি বই টান দিয়ে কথা শুরু করতেন। আর নানা রকম খাবার। পানি ইলিশ খাওয়াবেন আমাদের কয়েকজনকে। এটা না কী তাঁর রেসিপি। রেসিপি নিয়েই চলে গেলেন ভাই আমার।

সুন্দর ও আরামদায়ক-

সব কিছু তিনি চাইতেন যেন সুন্দর ও আরামদায়ক হয় । অনেক বারই বলেছি ‘হক ভাই এতো খরচ না করে কারো অফিসে বসে যদি মিটিং করা যেতো তাহলে তো চা সিঙ্গারা দিয়েই সেরে ফেলা যেতো’। তিনি প্রতিবারই বলতেন ‘এখন তো আর কেউ ছাত্র নাই। কত বিশিষ্ট একেকজন। হতে পারে তাঁরা রাবিয়ান। কিন্তু ভাবোতো তাঁরা অনেক বছর হয়ে গেছে আরেকটি জীবনে অভস্ত্য হয়ে গেছে। একটু গোছানো আর সুন্দর হলে ভাল। আর খাওয়াটাও জরুরি। অফিস সেরে দূর দূর থেকে আসে অনেকেই । ঢাকা শহর একমাথা থেকে আরেক মাথা অনেক সময় লাগে যেতে। কাজেই পেটভরে খাওয়া থাকা ভালো। কত টাকাই বা লাগবে? আর জীবনে টাকাতো সকলেই কিছু না কিছু রোজগার করেছো, করেছি। এখন না হয় রাবিয়ানদের জন্য খরচ হোক তার কিছুটা। যখন এলামনাই হয়ে যাবে তখন কমিটি সিদ্ধান্ত নিবে কিভাবে কী করবে।’ মানুষটির মনটিকে বুঝতে পারা যেতো এইসব আয়োজনে। তিনি খুব কঠোর এবং কোমলে মেশানো ছিলেন।

জুম মিটিং –

জানালেন ০৫ তারিখ জুম মিটিং করবেন, সব প্রার্থীদের নিয়ে। আমি যেন ব্যবস্থা করি সিনিয়রদের সাথে কথা বলে। ০৭ তারিখের জুম মিটিংয়ে বললেন আগামী ২০ তারিখ যত ভোটার ও প্রার্থী আছে সবাইকে নিয়ে জুম মিটিং করবেন। আমাকে জানালেন ব্যবস্থা নিতে। সেই ব্যবস্থা আর নিতে হলো না। আজ ২০ তারিখ হক ভাই। তারিখটি ঠিক রেখেছি আপনার কথা মত। আমরা মিলিত হচ্ছি আজ আবার আপনার বাড়ির চৌহদ্দিতে। শুধু আপনি থাকবেন না । বড় বেদনা নিয়ে কী চলে গেলেন ? আমাদেরকেও বেদনার্ত করে। কত সময় পার করেছি আপনার সাথে এই স্বল্প সময়ে সেসব লিখে শেষ করা যাবে না। বড় দ্রুত নিভে গেলো সময়ের আলো। কেন যেন মনে হয় সেই দীর্ঘ দেহ নিয়ে আপনি হেঁটে যাচ্ছেন প্যারিস রোডে। আপনার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায় নিজের ছায়ায়।

আমাকে লেখা আপনার শেষ লাইন ছিল “আমার মনে হয় সর্বাগ্রে শিক্ষা। এদেশে প্রচুর গৃহহীন মানুষের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা সহায়তা দেওয়া আজকের প্রয়োজন।” সেই সহায়তা দেবার আশায় শক্তিশালী এলামনাই গঠনের যে চেষ্টা ছিল আপনার সেটা আবার হয়তো কেউ না কেউ করবে, এগিয়ে নেবে স্বপ্ন, সেই আশা রাখি । আপনার আত্মার শান্তি হোক। প্রার্থনা। বড় বেদনা নিয়ে লিখছি কেন সব সুন্দর নষ্ট হয়ে যায় অসুন্দরের ছোয়াঁয়।

“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।”

মনোয়ারুল হক, প্রাক্তন রাবিয়ান মারা গেছেন গত ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, বুধবার, ৮০ দশকে মতিহারের পরিচিত মুখ সাবেক ছাত্রনেতা হক ভাইকে নিয়ে আরেক রাবিয়ান আপন এহসান এর অনুভূতি এফবি থেকে সংগৃহিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button