জাতীয়শিক্ষাসদরসিরাজগঞ্জ

কেন তিনি ঢাল তলোয়ার নামিয়ে দিলেন?

আবুল ইসলাম শিকদার: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে “সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়।” কিন্তু বাস্তবে এই পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের অনেকগুলো উপাদান রয়েছে, যেগুলো পররাষ্ট্র নীতিকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করে থাকে।

সে সব বিষয় একটু পরে আলোচনা করবো। সামনের কথাটা আগে বলি। নিজে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যা শিখেছি তারচেয়ে বেশি শিখেছি পৃথিবীর রাজনীতির বাস্তব গতি প্রকৃতি থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আচার অনুষ্ঠান আমাকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। এখান থেকেই আমি শিখেছি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সুগঠিত দেহ, গান বাজনা, অভিনয় ,কালো টাকা , পেশিশক্তি ইত্যাদি থাকলেই রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায়। পলিটিকাল সায়েন্স, ইকোনমিকস কিংবা পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের মাস্টার ডিগ্রী নিয়ে নমিনেশন চাইতে গেলে বলবে ব্যাটা পাগল কোথাকার।

যাকগে, সেসব কথা। বিশ্বের সার্বভৌম সকল রাষ্ট্র তত্ত্বগত ভাবে সমান মর্যাদা সম্পন্ন হলেও সবাই বাস্তবে সমান নয়। আমেরিকার পাগল প্রেসিডেন্টও যে জমকালো প্রোটকল পাবে বাংলাদেশের সুবোধ জ্ঞানী প্রধানমন্ত্রী কি সেই প্রোটোকল পায়? ভারতের জন্য যে জায়গাটি থাকে, চাদ বা সোমালিয়ার জন্য কি সেই জায়গাটি থাকে? রাশিয়া , আমেরিকা, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের ভেটো পাওয়ারের চেয়ে নির্মম আর অগণতান্ত্রিক কোন বিধান আছে কি? নেই। তবুও বিশ্ববাসী মেনে নিয়েছেন। এই ভেটো পাওয়ার ব্যবহার করে রাশিয়া যেমন আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে তেমনি আমেরিকা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনে ভেটো প্রদান করে ইসরায়েলকে ক্রমশ এক বর্বর শক্তিতে পরিণত করেছে।

 এসব বৈষম্যমূলক আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতার মধ্য দিয়েই আমাদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে পথ চলতে হচ্ছে।

একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান , সামরিক শক্তি , জনসংখ্যা , সরকার পদ্ধতি , জনগণের ঐক্য চেতনা , শিক্ষা সংস্কৃতি, আভ্যন্তরীণ সম্পদ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সে দেশের পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবতা।

ড. ইউনুস একজন বিদগ্ধজন। বিশ্ব রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর রয়েছে অগাধ পান্ডিত্য। বিশ্বের কোথায় তিনি যান নি। তাঁর জীবনের একটিই অপূর্ণতা , তিনি স্বদেশে আশানুরূপ সম্মানিত হননি। বরং বিগত সরকার প্রধানের ব্যক্তিগত ঈর্ষা এবং ক্রোধের শিকার হয়ে নানা রকম ভাবে হেনস্থা হয়েছেন। দেশের মানুষ এটা মন থেকে গ্রহণ করে নি। যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য সম্মান দেয়াটাই তারা উচিত বলে মনে করেছে।

যাহোক ,কথা না বাড়িয়ে চলে আসি সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে। ছাত্র জনতার আন্দোলনের ভেতর দিয়ে দেশে সরকার পরিবর্তন হলো এবং ইউনুস সাহেব প্রধান উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করলেন। ” বাগানে ফুল ফুটিল, পাখীরা গান গাহিল, ভোরে বাতাস বহিল।” সকলের মনে আশার সঞ্চার হলো।

এবার আর যেনো তেনো মানুষ নন স্বয়ং এক মহাজ্ঞানী মহাজন বাংলাদেশের মসনদে বসেছেন। যিনি ভরা কলসের মতো ভারী। কথা কম বলবেন, কাজ বেশি করবেন। রাত পোহালেই তাঁর নানা রকম ক্যারিসমা দিয়ে আমাদের বিস্মিত করবেন।

না তেমনটি হলো না গোড়া থেকেই। কথায় যেনো আগের জনকেও ছাড়িয়ে গেলেন। কথার তুবড়ি ছাড়লেন প্রথম দিনেই। তারপর নানা ভাবে ছাত্র প্রশাসনের দ্বারা একেবারেই আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে গেলেন। ছাত্ররা তো নবীন -যুবক। তারা অনেক কিছুই বলতে পারে। ভুলও করতে পারে। কিন্তু তিনি তো প্রজ্ঞাবাণ জ্ঞানী , অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। তিনি কেন যুবকদের সকল কথায় তাল মিলিয়ে নিজের ভারিক্কি নষ্ট করবেন? তাঁর হাতে থাকবে নিয়ন্ত্রণের লাগাম। তিনি এমন সব কথাবার্তা বলা শুরু করলেন যা তার এনজিও দর্শনের সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক। নারী স্বাধীনতা, ধর্ম দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি যেনো কেমন একটু উগ্রতাকেই বেছে নিলেন।স্বয়ং জামাতের আমীর সাহবেও যেখানে নানা ভাবে ধর্মীয় সহনশীলতার কথা বললেন সেখানে তিনি যেনো তার আমেরিকান চরিত্রকে একেবারে আড়াল করতে চাইলেন। ভাগ্যিস কন্যার অপেবা সংগীতের শেষে তার হর্ষধ্বনি আর হাত তালির রেকর্ডটা সংরক্ষিত ছিল।

এসবও বাদ দিলাম। তিনি সবার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে যে নগ্ন ভারত বিরোধীতা শুরু করলেন তাতে আমরা একটু বিস্মিত হলাম। “ভারতের দালাল” হওয়ার প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। ভারত একটি স্বার্থবাদী রাষ্ট্র। তার সাথে পাকিস্তান , নেপাল ভুটান, শ্রীলঙ্কা কারো সাথেই সম্পর্ক ভালো নয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের সরকারকে সবসময়ই কৌশলী হওয়ার বার্তা দিয়ে যায়। তাছাড়া ভারতের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের ইতিহাস একেবারেও শুন্য কলসি নয়। হয়তো ভারত বেশী লাভবান হয়েছে। কিন্তু আমাদের নানা বিপদে আপদে তারাই সবার আগে এগিয়ে এসেছে।

তাহলে বিশাল ভারতের সাথে আমাদের কুটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে অবশ্যই কৌশলী হতে হবে। তা না করে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে সস্তা সব নিম্নমানের বিরুদ্ধ বাণী তো বর্ষণ করলেনই উপরন্তু সেভেন সিস্টার সম্পর্কেও একটু বালখিল্যতা করলেন। গরুর বিনিময়ে ইলিশ দিতে চাইলেন। অনেক তামাশাপূর্ণ কথা বার্তা বললেন, যেটি হয়তো এনজিওর মিটিংয়ে চলে কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে চলে না।

ঠিক একই সময় এতোসব তিক্ত কথার বিপরীতে মদি সাহেব কিন্তু হুলুস্থুল করলেন না। তিনি ঠান্ডা মাথায় বললেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক হবে আরো বন্ধুত্বপূর্ণ। এবং ইউনুস সরকারের সাথে তারা কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমরা যেনো কুটনৈতিক ক্ষেত্রে একটু হোঁচট খেয়ে গেলাম।

আমরা সাধারণ মানুষ ভাবলাম, তিনি নিশ্চয়ই ফাউ ফাউ এতো কথা বলেননি। নিশ্চয়ই আমেরিকার কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক চেক পেয়েছেন। সে চেকে আছে ডলার এবং গোলা বারুদ সবই। এইবার ভারতকে জাত করার মতো ওল্ডম্যান পাওয়া গেছে।মনে মনে শংকা থাকলেও খুশিই হলাম। পাকিস্তানের পেয়াজ খাবো, চায়না জুতো পড়বো, আমেরিকার ডাক্তার দেখাবো। কীসের ইন্ডিয়া ফিন্ডিয়া।

এই ভাবটা ধরে রাখতে পারলে মন্দ ছিল না। কিন্তু মাত্র একমাসের মাথায় প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী দাপুটে ইউনুস এমন করে চুপসে গেলেন কেন? কি ঘটলো পর্দার অন্তরালে? একেবারে ঢাল তলোয়ার নামিয়ে দিলেন যে? বললেন, ভারত এবং ভারতই আমাদের একমাত্র প্রতিবেশী। তার সাথে সম্পর্ক হবে মধুর পিরিতিপূর্ণ। না, ইউনুস সাহেব আমরা এমনটিও চাইনি। আমরা আপনার আস্ফালনের সমালোচনা করেছি, তাই বলে এমন করে নতজানু হবেন সেটিও প্রত্যাশা করিনি। আপনি হবেন কৌশলী, বাগ্মী, প্রত্যুতপন্নমতি, ক্ষুরধার যুক্তিবাদী এবং সমমর্যাদার দাবীদার। মোদির মতো অবিদ্বান আপনার সামনে কাচুমাচু করবে। এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু শেষমেশ আপনি যা করলেন, তাতে গর্জনের সাথে বর্ষনের মিল হলো না। খামাখা ভালো জায়গা কেন—- য়ে ঘা করলেন?

যাকগে তবু আমরা আশাবাদী। বিশেষ করে আপনার একটা কথায় আমরা বড়ই প্রীত হয়েছি। আপনি বলেছেন, ” আপনারা আমাদের বেশি বেশি সমালোচনা করুন যাতে আমরা সঠিক কাজটি করতে পারি।” এ তো দারুণ প্রজ্ঞার কথা। সেই ভরসাতেই একটুখানি কলম চালাই আর কি।

লেখক: অধ্যক্ষ আবুল ইসলাম শিকদার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button