সদরসাহিত্যসিরাজগঞ্জ

লজ্জার  ভয়, নাকি ভয় পাওয়ার লজ্জা ?

Eye Hospital Rajshahi

রেহমান মিজান

লেখক, কবি, মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মী

মানুষই একমাত্র জীব যার মাঝে কিছু হারানোর ভয়, আহত-নিহত হওয়ার ভয়,  আপদ-বিপদের ভয় ও নিজের অস্তিত্ব বিলোপ হওয়ার পাশাপাশি লজ্জা পায়  এবং লজ্জা পাওয়ার ভয়ও পায়। লজ্জা পাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও লজ্জাজনক কাজ বারে বারে  করে,  তার পেছনে যুক্তি দেখায়, লজ্জা প্রকাশ পাবে এই ভয়ে লজ্জা ঢাকার জন্য  নানান ফন্দিফিকির করে।  এখানে বলে-কয়ে রাখি লজ্জা বিষয়ে লিখলে মানুষ কীভাবে নিবে, মানুষ কী ভাববে সেটা নিয়ে আমার কোন লজ্জা পাওয়ার  ভয় কাজ করছেনা।  লজ্জা পাওয়ার প্রেক্ষাপট, লজ্জা কেন পায়?  নারী-পুরুষের শরীরের লজ্জাস্থান কতটুকু অংশ?, লজ্জা কি শুধু মাত্র কাপড় দিয়ে মানব দেহ ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ?  চক্ষু লজ্জা, মন-মানসিকতার লজ্জা, সামাজিক ব্যবস্থার লজ্জা কী আলাদ আলাদ? তা ভাববার বিষয়। আর কতটুকু ঢেকে রাখলে লজ্জা নিবারণ হয় তা  দেশ, সময়, স্থান-কাল-পাত্র , ধর্ম-গোত্র ভেদে ভিন্ন হয় বলে সমাজ বিজ্ঞানীদের মতো  আমিও তা মনে করি।  পৃথিবীর বিখ্যাত-বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী, মনীষী, লেখক, কবি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের লেখায় লজ্জা সংক্রান্ত লেখনী ভালোভাবে উঠে এসেছে। প্রখ্যাত মনো-বিজ্ঞানী সিগমন্ড  ফ্রয়েড (Sigmund Freud) তার দ্য ইগো অ্যান্ড দ্য ইড” (The Ego and the Id), ১৯২৩ গ্রন্থে লজ্জাকে একটি আত্ম-সম্মানজনিত অনুভূতি, যা আমাদের সমাজের নিয়ম ও মানদণ্ডের সাথে আমাদের আচরণের অসঙ্গতির কারণে উদ্ভূত  হয় বলে উল্লেখ করেছেন।  অ্যারিস্টটল (Aristotle) তার  বিখ্যাত গ্রন্থ “নিকোম্যাকিয়ান এথিকস” (Nicomachean Ethics), বই ৪, অধ্যায় ৯ এ লজ্জাকে যুবকের জন্য শোভন এবং তার বৃদ্ধের জন্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি লজ্জাকে ভুলের অনুভূতি এবং বৃদ্ধরা লজ্জাজনক কাজ না করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। জন মিল্টন (John Milton) তার অন্যান্য সৃষ্টি প্যারাডাইস লস্ট” (Paradise Lost), বই ৪, লাইন ৩১৩ এ লজ্জা কে একটি আত্মার অনুভূতি, যা পাপের পর জন্মায় বলে বর্ণনা করেছেন। জ্যঁ-জাক রুসো (Jean-Jacques Rousseau) তার বই-৪ এমিল” (Emile) এ লজ্জা কে একটি সামাজিক অনুভূতি, যা আমাদের অন্যদের দৃষ্টিতে নিজেদের মূল্যায়ন করতে শেখায় বলে  ব্যাখ্যা করেছেন। সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৪ এ লজ্জাকে  ইসলামের প্রথম স্তম্ভ ইমানের অংশ  বলে বলা হয়েছে। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধীর ইয়ং ইন্ডিয়া” (Young India), ১৯২৫ লেখনিতে লজ্জা মানুষের আত্মার রক্ষা কবচ বলে লিখেছেন।

নিজের পছন্দ বা পারিবারিক আয়োজন যেভাবেই হোক দুজন সক্ষম নারী-পুরুষের বিয়ে হয় এবং  এ প্রক্রিয়ায় একজন নারী তার ২০-২৫ বছরের স্মৃতি বিজড়িত বাবা-মায়ের বাড়ি, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, চেনা পরিবেশ ছেড়ে নতুন একটি পরিবারে স্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে চলে আসেন।  শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় বাবা-মা   উৎকণ্ঠা ও ভয়ের সাথে যে  বার্তাটা মেয়ের মস্তিষ্কে  ঢুকিয়ে দেয় তা হলো জামাই বাবাজির কথা শুনবি, শ্বশুর-শ্বাশুরির খেদমত করবি, মাথা ঠান্ডা ও ধৈর্যসহকারে সংসার করবি।  না হয় আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবো না, সবাই মুখের উপর বলবে ওমুকের মেয়েটা সংসার করতে পারলো না। 

নতুন সংসারে এসে  বাবা মায়ের  উপদেশ মোতাবেক পান থেকে চুন খসলে সবার সামনে লজ্জায় পড়তে হবে এই ভয়ে আদা-জল খেয়ে ২৪/৩৬৫ দিনে লেগে পড়ে স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরির সেবা করা,  রান্না ঘর সামলানো, ননদ-ননাস ও অন্যান্য সদস্যদের সার্ভিসে দেওয়ার কাজে। কর্মজীবী হলে তো অফিস, বস ও সহকর্মীদের সামলানোর মতো বাড়তি কাজ করতে হয়। কী রান্না করবে, কতটুকু রান্না করবে, ঝাল-সিদ্ধ কেমন হবে প্রতি পদে-পদে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বারে বারে জিজ্ঞেস করলে বলবে মা-বা কিচ্ছু শেখায় নাই, বউটা কিচ্ছু পারে না আর না জিজ্ঞেস করলে ছেলের কাছে গিয়ে বিচার দিবে তোর বউ আমাকে সম্মান করে  না, পাত্তা দেয় না। যদি কটু বাক্য শুনায়, মা-বাবা তুলে কথা বলে এই লজ্জা কীভাবে সামলাবো এই ভয়ে গৃহবধুটি সবসময় তটস্থ থাকে। প্রত্যেকটা বাসার পুরাতন কাজের বুয়া 

অনেকটা গোয়েন্দা প্রধান এর মতো কিছু হলেই  মুহূর্তের মধ্যে  শ্বাশুড়ির কানে দিয়ে দিবে আর  দেওয়া মাত্র শুরু হয়ে যাবে ওয়াজ-নসিহত। শুধু মাত্র লজ্জার ভয়ে  একজন নারী তার ব্যক্তিগত স্বাদ-আল্লাদ, আবেগ, ভালোলাগা বিসর্জন দিয়ে যায়। তার প্রতি কোনো প্রকার অন্যায় হলেও মাথা নীচু করে সহ্য করে নেয়। স্বামীর পক্ষের কোনো আত্মীয়-স্বজন দ্বারা প্রতিনিয়ত মানসিক অত্যাচারের শিকার হলেও সম্পর্কের অবনতি হবে এ ভয়ে স্বামীর কাছে নাশিল করতে পারে ভয় পায়। প্রথম পর্যায়ে এসব সমস্যার কথা বাবা-মায়ের স্মরণে আননেও পরবর্তীতে মা-বাবা মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে নীরবে নিভৃতে চোখের পানি ফেলা ছাড়া  আর কিছুই করে না।  জীবন সঙ্গী কর্তৃক  মানসিক নির্যাতনের কথা না হয় বাদই দিলাম, শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হলে  কাউকে বলা বা আইনের দারস্থ হওয়াকে লজ্জাজনক বিষয় বলে মনে করে।  সামাজিক মর্যাদার হানী ও লোক-লজ্জার ভয়ে বিষয়টি মেনে নিয়ে বছরের পর বছর সংসার করে যায়। বাংলাদেশে এখনো এমন মানুষ আছেন যারা স্ত্রী নির্যাতনকে অপরাধ মনে  করে নাম বরং এটাকে অনেক সময় গর্বের বিষয় হিসেবে দেখে। এমনকি জঘন্য পারিবারিক সহিংসতার শিকার অনেক নারীও আছেন বাংলাদেশে  এটাকে সমস্যা বা অপরাধ হিসেবে মনে করে না, বরং স্ত্রী মারার হক নাকি স্বামীর আছে বলে মনে করেন।  নারী অধিকার, নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা অনেক বাঘা-বাঘা মানবাধিকার কর্মী আছে যারা বাস্তবে তারা  তাদের নিজের স্ত্রী বা পুত্রবধূর চলা-ফেরা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা শুধু মাত্র বাড়ির সিঁড়ি গোড়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেন। সভা সেমিনারে  নারীর প্রতি এমন সহিংসতার কথা বলতে গিয়ে কেবল গ্রামের উদাহরণ দেয়।  কিন্তু থাই রঙিন গ্লাসে, ইট-পাথরের চার-দেয়ালের লাল-সাদা, আকাশি ইমারতের ভিতরের খবর প্রকাশ্য দিবালোকে আসে না শুধু লোক-লজ্জার ভয়ে, সামাজিক মর্যাদার ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে।  কালো রোদ চশমা আর রঙিন ম্যাক-ওভারের আড়ালে কত নারীরা যে তাদের আশা-আখাংকা, দুঃখ বেদনা লুকায় সেটা খুব কাছ থেকে না দেখলে বুঝা যায় না। ২০১৮ সালে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম (জেএনএনপিএফ) এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ”বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার উপর দৃষ্টিপাত : প্রবণতা এবং সমাধান” শীর্ষক গবেষণাপত্রে  গবেষক ইব্রাহিম  বাংলাদেশের ৬৬% নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন বলে তথ্য  উপস্থাপন করেছেন এবং এর কারণ হিসেবে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচার প্রাপ্তির নিম্নহার সম্পর্কেও আলোকপাত  করেছেন।  অন্যদিকে  ২০২৪ গবেষক জনাব রওনক জাহান কেয়ার বাংলাদেশ, জাগো ফাউন্ডেশন ও আইসিডিডিআর,বি এর যৌথ গবেষণার ভিত্তিতে রচিত ”পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি ও আমাদের করণীয় প্রবন্ধে” বাংলাদেশের সাতটি বিভাগে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ১,৭১৫ জন নারীর সাথে সাক্ষাৎকারের ফলাফল উপস্থাপন করে  দেখিয়েছেন যে,  ২৫-৩৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৪৪% এবং ৪৫-৫৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৩৭% শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।একটা শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়,  সাথে সাথে আয়া, ডাক্তার, আত্মীয়-স্বজন  প্রথমেই পা-উল্টিয়ে দেখে শিশুটি ছেলে না মেয়ে, এতে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া জামা-কাপড় বিহলি শিশুটি লজ্জা পায় না কারণ তার মধ্যে লজ্জাবোধ তখনো জাগ্রত হয়নি। কিন্তু প্রত্যাশিত সন্তানটি ছেলে না হওয়ায়  গর্ভধারিণি মা ও তার পক্ষের আত্মীয়-স্বজন  কটূক্তি শুনার ভয় ও লজ্জা দুটোই পায়। একজন মায়ের গর্ভধারণ করার আগে বা  শুরুতে একটা ভয়ের মধ্যে পড়ে যায়, যে তার অনাগত সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে, সে কী পরিবারের প্রত্যাশা পুরুন করতে পারবে ?  যদি সে শ্বশুর বাড়ির লোকদের প্রত্যাশা পুরুন করতে না পারে সে লজ্জায় মুখ দেখাবে কী করে?  বিয়ের পর সন্তান ধারণ করতে দেরি হলে শুর হয় কানাঘুষা, গালমন্দ সহ অনেক অবাঞ্ছিত শব্দ। পুরুষ মানুষের সমস্যা থাকলেও কটু কথা শুনতে হয় নারী কে। সমস্যাটা কোথায়? কেন এ বিষয়ে জানার জন্য ভাল ডাক্তারের কাছে পর্যন্ত নিতে চায় না বর পক্ষ। সমস্যা যদি পুরুষের হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে পরিক্ষা-নিরিক্ষার জন্য বলা হলে নারীর উপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন, শুধু তাই পুরুষের সমস্যা থাকলে দোষ আসে নারীর ঘাড়ে।   অবস্থার অনেক উন্নতি হলেও এখনো সন্তান না হওয়ার জন্য বা ছেলে সন্তান না হওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি তালাক বা একাধিক বিয়ে করার প্রবণতা বাংলাদেশে এখনো বিদ্যমান।  (চলবে)…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button