ইসমাইল হোসেন: ১৯৬১ সালের ১ মে তদানিন্তন পাবনা জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা উদ্যোগি হয়ে প্রেস ক্লাব গঠন করে। প্রয়াত সাংবাদিক আজিজুল হক এর বাসায় গঠন করা হয় প্রেস ক্লাব। প্রথম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন প্রয়াত আজিজুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন স্বর্গীয় রণেশ মৈত্র।
পাবনায় প্রেসক্লাব গঠনের পরের বছর ১৯৬২ সালে সিরাজগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন ইনাম আহমেদ চৌধুরী। তিনি ছিলেন সাহিত্য, সংস্কৃতির অনুরাগী। তাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে গঠিত হয় সাংবাদিকদের পেশাগত প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির সিরাজগঞ্জ মহকুমা শাখা। প্রথম সভাপতি সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম এম.এ. এবং সাধারণ সম্পাদক হন হাবিবুল আলম। সমসাময়িক সময়ে সিরাজগঞ্জের সাংবাদিকগন উদ্যোগি হন সাংবাদিকদের পেশাগত ক্লাব প্রেসক্লাব গঠনে।
১৯৬৩ সালের ২২ মে সিরাজগঞ্জ সাংবাদিক সমিতি সাংবাদিকদের পেশাগত ক্লাব গঠনের উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে সাংবাদিক সমিতি ও প্রেসক্লাব এর নামে আয়োজন করে চা-চক্রের। ওই চা-চক্রে অতিথি হিসেবে সস্ত্রীক উপস্থিত হন মহুকুমা প্রশাসক ইনাম আহমদ চৌধুরী। সভায় সমিতির কার্যক্রম তুলে ধরেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল আলম। ওই সভায় গঠিত হয় সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাব এর প্রথম কমিটি। প্রথম কমিটির সভাপতি হন প্রয়াত সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম এম.এ. ও সাধারণ সম্পাদক হন হাবিবুল আলম। সভায় প্রেস ক্লাব এর ভবন নির্মানের বিষয় আলোচিত হয়। সভায় বক্তৃতায় মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় প্রেসক্লাব সম্পর্কে বলেন, তিনি খুব শীগগিরই প্রেসক্লাবের উদ্বোধন করবেন। এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় সুধীবৃন্দকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
এই সভার সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল আলম সিরাজগঞ্জ সাংবাদিক সমিতির জন্ম ও কার্যক্রম তুলেন ধরেন। এবং আশা প্রকাশ করেন শীঘ্রই তারা সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইনাম আহমদ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় প্রেস ক্লাব দ্বার উদঘাটন করবেন। সংবাদটি ছবিসহ প্রকাশিত হয় মহুকুমা প্রশাসক ইনাম আহমদ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ৭ জুন ১৯৬৩ সালের পাক্ষিক যমুনা পত্রিকার ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায়।
পরের বছর ১৯৬৪ সালে মহকুমা প্রশাসক ইনাম আহমদ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় শহরের মাড়োয়ারী পট্টীস্থ তদানিন্তন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক) এর সামনে সরকারি খাস ভুমিতে প্রেসক্লাব ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। এতথ্য নিশ্চিত হওয়া যায় সিরাজগঞ্জ থেকে প্রকাশিত যমুনা পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদের সদস্য প্রয়াত আইনজীবী অ্যাড. ফজলার রহমান খান এর লেখা সিরাজগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থে। ওই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়- ১৯৬৪ সালে মুজিব সড়ক ( মাড়োওয়ারী পট্টীতে) তদানিন্তন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমানের সোনালী ব্যাংক) এর সামনে ১৯৬৪ সালে সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাব ভবন এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। সে সময়ে সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক ইনাম আহমদ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রেস ক্লাব এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রী এ.টি.এম. মোস্তফা। পরবর্তী সময়ে ওই স্থান টিএন্ডটি বিভাগ এর নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। একই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে প্রেস ক্লাব এর সাথে যুক্ত ছিল সাইফুল ইসলাম, রামকৃষ্ণ সাহা, গোবিন্দ ঘোষ, আব্দুল রউফ, মিজানুর রহমান, হাবিবুল আলম প্রমুখ।
চৌধুরী বদরুজ্জোহা লিখিত সিরাজগঞ্জের ইতিহাস বিষয়ক অপর এক গ্রন্থে দেয়া তথ্যে এর সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়। ওই গ্রন্থের লেখক ১৯৮৫ সালের মে মাসের ১৮ তারিখে সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব এর টিন শেড এর ভবনে তথ্য সংগ্রহের জন্য যান। সেসময় স্বর্গীয় সাংবাদিক রামকৃষ্ণ সাহা ও ক্লাব এর অন্যান্য সদস্যের নিকট থেকে একই তথ্য প্রাপ্ত হন।
এই প্রবন্ধের লেখক ইসমাইল হোসেন এর একই এলাকায় পৈত্রিক বাসা। শৈশবে লেখক বর্তমান সোনালী ব্যাংক ( সাবেক ন্যাশনাল ব্যাংক) এর সামনে প্রেসক্লাব এর ওই মাঠে খেলাধুলা করতেন। প্রবন্ধের লেখকের স্মৃতি থেকে জানা যায়, ‘সে সময় বর্তমান ওয়ারলেস এলাকার মাঠে প্রবেশের মুখে ডানপাশে একটি সাইনবোর্ড ছিল। সাইনবোর্ডটি আনুমানিক তিনফুট বাই দুইফুট এবং দুটি খুটির ওপর লাগানো ছিল।’ পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে টিনশেড প্রেসক্লাব ভবনে সেসময়ে সাংবাদিক সমিতির একাংশের সভাপতি প্রয়াত মিজানুর রহমান তালুকদার লেখককে জানান টিএন্ডটি কার্যালয়ের ওই স্থানেই ১৯৬৪ সালে সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব ভবন এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং মিজানুর রহমান জানান, প্রেস ক্লাব এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন প্রয়াত কন্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ, তবলা বাজিয়েছিলেন প্রয়াত চলচ্চিত্র নায়ক জাফর ইকবাল।
কিন্ত প্রেস ক্লাব ভবনের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানটি ১৯৬৯ সালে টিএন্ডটি বিভাগকে বরাদ্দ দেয়া হয় এবং ওই এলাকায় ১৫০ মিটার উচু টাওয়ার নির্মিত হয়। এঅবস্থায় প্রেস ক্লাব ভবন না থাকায় সাংবাদিকগন কাজ করতেন নিজ নিজ বাসা থেকে। কখনও কখনও কাজ করতেন তথ্য কেন্দ্র ( ইনফরমেশন সেন্টারে) বসে।
স্বাধীনতার পর সাংবাদিকগন আবারও প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ের উদ্যোগি হন। ফলে সরকার শহরের পুরাতন পোষ্ট অফিস রোডে সিরাজগঞ্জের সাংবাদিকদের জন্য একটি ভবন বরাদ্দ দেয়। ওই স্থানেই স্বাধীনতার পর সাংবাদিক সমিতি ও প্রেসক্লাব এর কার্যক্রম পরিচালিত হত। যুদ্ধাহত প্রবীণ সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী জানান শহিদ এম. মনসুর আলী ওই ভবনে সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব এর উদ্বোধন করেন। প্রবীণ সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, স্বাধীনতার পর প্রথম প্রেস ক্লাব এর সভাপতি ছিলেন সাইফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল কুদ্দুছ। পরবর্তীতে সভাপতি হন রফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল কুদ্দুছ।
কিন্ত বরাদ্ধকৃত ওইস্থানটির মালিকানা সংক্রান্ত মামলায় প্রাক্তন মালিকের পক্ষে আদালত রায় প্রদান করেন। ফলে ভবনটি ছেড়ে দিতে হয়। পরে ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর বি এ কলেজ রোডের বর্তমান জেলা জাসদ অফিসে কিছু সময় প্রেসক্লাব এর কার্যক্রম পরিচালিত হত।
বহু চড়াই উৎড়াই শেষে ১৯৭৭ সালে তৎকালিন মহকুমা প্রশাসক মুক্তাদির চৌধুরী শহরের চৌরাস্তা মোড়ের বর্তমান স্থানে একটি অনাগরিক সম্পত্তি প্রেস ক্লাব এর নামে বরাদ্দ দেন। ১৯৭৮ সালে ওই বরাদ্দকৃত স্থানে ইটের দেওয়াল ও টিনশেড প্রেস ক্লাব কার্যালয় নির্মিত হয়। এবং প্রেসক্লাব এর কার্যক্রম শুরু হয়।
২০১১ সালে টিনশেড ভবনটি ভেঙে বাসদ মাহবুব এর জেলা শাখার সম্মতিতে প্রেস ক্লাব সদস্য ইসমাইল হোসেন এর মধ্যস্থতায় ক্লাব সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন এর উদ্যোগি ভুমিকায় এক চুক্তিনামা সাক্ষরের ভিত্তিতে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস এর প্রচেষ্টায় সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ বর্তমান চারতলা ভবনটি নির্মান করে। চুক্তি সাক্ষরের সঙ্গে আরও যুক্ত ছিল সে সময়ের ক্লাব সভাপতি হারুন অর রশিদ হাসান ও জেলা জাসদ সাধারণ সম্পাদক আবু বকর ভুইয়া। নির্মিত ওই ভবনের সাল ১৯৭৮। এটা সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার বছর নয়। সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব ভবন নির্মানকালের বছর।
প্রকৃতঅর্থে সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার বছর ১৯৬৩ সাল। এবং ১৯৬৩ সালের ২২ মে মহকুমা প্রশাসকের উপস্থিতিতে এক চা-চক্রের মধ্যদিয়ে সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথম প্রেসক্লাব এর সভাপতি হন প্রয়াত সাইফুল ইসলাম এম.এ. এবং সাধারণ সম্পাদক হন হাবিবুল আলম। লেখক: ইসমাইল হোসেন, সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব এর সদস্য ও দৈনিক সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন এর নির্বাহী সম্পাদক।