ইসমাইল হোসেন : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রভুমি বাংলাদেশ। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী। ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জাতির পিতার মুক্তির ঘোষণা দিতে বাধ্য হলো। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসলেন। দেশ পরিচালনায় ৭০ এর নির্বাচিত জাতিয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠন করলেন গণপরিষদ। তৈরী করলেন স্বাধীন দেশ পরিচালনায় পবিত্র সংবিধান। বৈদেশিক নীতি ঘোষিত হলো সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে শক্রতা নয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এশিয়ার সুইজারল্যান্ড হবে বাংলাদেশ। এই বাণি নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল যাবে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কো। প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য সিরাজগঞ্জের জননেতা মোতাহার হোসেন তালুকদার। কিন্ত পররাষ্ট্র দফতরে গিয়ে দেখা গেল বিদেশ যাওয়ার কাগজপত্রে মোতাহার হোসেন তালুকদার নামেরস্থলে লেখা মোতাহার মাষ্টার। কর্মকর্তাদের কাছে থেকে জানা গেল বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখে দিয়েছেন- মোতাহার মাষ্টার নাম।
প্রয়াত মোতাহার হোসেন তালুকদার ছুটলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন আমার নাম মোতাহার মাষ্টার নয়। নাম মোতাহার হোসেন তালুকদার। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আরে শোন, উকিল বললে আমি মালেক উকিল বুঝি, মাষ্টার বললে, ‘মোতাহার মাষ্টার বুঝি, যা ভাগ।’
প্রয়াত মোতাহার হোসেন মেনে নিলেন বঙ্গবন্ধুর আদেশ। চলে গেলেন তার শান্তির বাণি নিয়ে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়ার) রাজধানী মস্কো। আজ ২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের এই জননেতা, বঙ্গবন্ধুর সেই মোতাহার মাষ্টারের ২১তম মৃত্যু দিবস।
প্রয়াত এই নেতা জন্মেছিলেন ১৯২০ সালে সিরাজগঞ্জের অদূরে গজারিয়া গ্রামে। বাবা নইমুদ্দিন তালুকদার ছিলেন শিক্ষক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছেলেবেলায় শুভগাছা গ্রামের জিয়ার পন্ডিতের পাঠশালা, ম্যাট্রিকে পাবনার জিসি ইন্সষ্টিটিউট থেকে। এরপর আইএসসি পাস করেন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে। পরে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে সমাপ্তি টানেন ছাত্র জীবনের।
জননেতা মোতাহার মাষ্টার রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন সেই ছাত্রজীবনেই। দেশভাগের আগে ছিলেন নিখিল বঙ্গমুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য। ১৯৪৬ সালের পাকিস্তান আন্দোলনের নির্বাচনে কাজিপুরে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করেন। ছাত্রনেতা হিসেবে ৪৮ সালে তিনি গোটা উত্তর বাংলা চষে বেড়িয়েছেন ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে।
ভাষা সংগ্রামী মোতাহার হোসেন ১৯৫২ সলে বিএসসি শিক্ষক ছিলেন স্থানীয় হাজী আহম্মদ আলী হাই স্কুলে। এই সময়ে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে ক্লাস বর্জন করেন। ফলে ইতি ঘটে শিক্ষাকতা জীবনের। আরও গভীরভাবে সক্রিয় হয়ে পড়েন জাতীয় রাজনীতিতে।
১৯৪৯ সালে ৬ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে সিরাজগঞ্জের আরেক এক কৃতী সন্তান মওলানা আবব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। এর প্রায় ৪ মাস পর ১৯৪৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জে গঠিত হয় মহুকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগ। এই কমিটিতে প্রয়াত মোতাহার মাষ্টার নির্বাচিত হন সাংগঠনিক সম্পাদক। সেই থেকে ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছিলেন সিরাজগঞ্জ আওয়ামী মুসলিম লীগ পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি। তিনি ছিলেন আমৃত্যু সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের নৌকার মাঝি।
প্রয়াত এই নেতা গোটা জীবনে জীবিকার তাগিদে ব্যবসা করলেও তার মন ছিল রাজনীতিতে। দীর্ঘ ৫৫ বছর রাজনৈতিক জীবনে সান্নিধ্য পেয়েছেন যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসাইন শহিদ সোহরাওয়ার্দ্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো দেশ বরণ্য ব্যক্তিদের।
মোতাহার মাষ্টার মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবারণ করেছেন একাধিকবার। ৭০ সালে কারাগার থেকেই নির্বাচিত হন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ১১ নং সেক্টরে য্দ্ধু পরিচালনা করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন নিয়ে এলে তিনি হন সিরাজগঞ্জের গভর্ণর।
প্রয়াত মোতাহার হোসেন আবাস গড়েছিলেন শহরের মারোয়ারীপট্টী আজকের মুজিব সড়কে। রাজনীতিতে তার বাড়ি হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের জাতীয় নেতাদের আবাসস্থল। এই বাড়িতেই উঠেছেন এবং থেকেছেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দ্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহিদ এম. মনসুর আলী এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা শাহজাহান সিরাজ, আ ফ ম মাহবুবুল হকসহ অনেক দেশবরণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোতাহার মাষ্টার দীর্ঘ ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে নানা ঘটনা, আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করে এই অঞ্চলের ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬ দফার আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুন্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ সালের মহান মুক্তিয্দ্ধু এবং যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশ গঠনে নেতৃত্ব দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনকে এক ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বরে।
আজ শারিরীকভাবে পৃথিবীতে তিনি অনুপস্থিত থাকলেও সিরাজগঞ্জের মাটি ও মানুষের কাছে তিনি দলের উর্দ্ধে এক রাজনীতিক। জীবদ্দশায় ছিলেন জননেতা। মৃত্যুর পরও তিনি জননেতা মোতাহার মাষ্টার হিসেবেই আছেন, থাকবেন উত্তর জনপদের যমুনা পারের মানুষের কাছে।আজ ২১তম মৃত্যুদিবসে এই জননেতার প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন, ভালো থাকুন।