জাতীয়শিক্ষাসদরসাহিত্যসিরাজগঞ্জ

৪৮ সালে সিরাজগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক মীর আবুল হোসেন আর নেই

ইসমাইল হোসেন: লেখক, সমালোচক, সংস্কৃতিকর্মী, অধ্যাপক বিশেষ করে কথাশিল্পী ও সিরাজগঞ্জের ভাষা সৈনিক মীর আবুল হোসেন আর নেই। তিনি গত মঙ্গলবার ১২ নভেম্বর ঢাকার বনানীর নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্নানিল্লাহি………..রাজিউন)।

ভাষা সৈনিক মীর আবুল হোসেন সিরাজগঞ্জের মেছড়া খামারপাড়ায় ১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, নিয়মানুবর্তী ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন যাপন করেন।

আবুল হোসেন ছাত্রজীবন থেকেই অন্যায় অত্যাচার নিপড়নের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি এবং তার বন্ধু ভাষা সৈনিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক প্রয়াত সাইফুল ইসলাম সহ কয়েক বন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা কোনও সরকারি চাকরি করবেন না। বিএল স্কুলের প্রক্তন শিক্ষার্থী আবুল হোসেনসহ কয়েকজন আদর্শবাদী নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক যুবকের জীবনে বৃটিশবিরোধী শিক্ষকের প্রভাব ছিল।

১৯৪৮ সালে আবুল হোসেন, বন্ধু সাইফুল ইসলাম ও বন্ধু নজরুল ইসলাম খান তিনজন মিলে শুরু করেছিলেন সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন। সে সময়ে শহরে ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’ নামে পরিচিত হন এই তিন ভাষা সৈনিক তরুন।

বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ৪৮ সালের ১১ মার্চ তিন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিবাদ করবেন। সংবাদপত্রের মারফত জেনে তিনবন্ধু সিরাজগঞ্জে ১১ মার্চ ধর্মঘটের আহবান করলেন।

সে সময় মাইক ছিল না। টিনের চোঙ্গা নিয়ে সংগঠক সাইফুল ইসলাম ও সৈয়দ কায়সার আলী স্কুলের গেটে গেটে ধর্মঘট প্রচার করলেন। পাতিলের কালি আর গাবের আটা দিয়ে পেষ্ট তৈরি করে পুরানো সংবাদপত্রের পাতায় শ্লোগান লিখে দেয়ালে সাটিয়ে দিতেন।

তখন মীর আবুল হোসেন পড়তেন সিরাজগঞ্জ কলেজে। পরে সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষা দিয়ে মীর আবুল হোসেন কিছু দিনের জন্য গ্রামে আসেন।

১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ সারা দেশে আছড়ে পড়ে। সে সময়ে তিনি মেছড়াতে থাকলেও প্রতি সপ্তাহেই আসতেন সিরাজগঞ্জ শহরে। আন্দোলনে, রাজনৈতিক সভা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বন্ধুরা ডেকে পাঠাত। শহরে বন্ধু সাইফুল ইসলাম কিংবা খুরশিদ আলমের বাসায় থাকতেন। কখনও বা কলেজ হোস্টেলে অবস্থান করতেন। ভাষা আন্দোলনের সময় একটানা কয়েকদিন সাইফুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় বিশেষ ভূমিকা ছিল তার এবং সাইফুল ইসলামের। তাদেরকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন সৈয়দ আকবর আলীর (বার্মায় রাষ্ট্রদূত) তিন পুত্র ওয়ারিশ, হায়দার এবং কায়সার। টাকা-পয়সার প্রয়োজন হলে তদের বন্ধু খুরশিদ আলমের শরণাপন্ন হতেন।

৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা গুলিবষর্ণনের পর তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় সর্বদলীয় ভাষা সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। ঢাকা বার লাইব্রেরীর মিলনায়তনে বিভিন্ন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংস্থার প্রতিনিধি ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিল। জেলা শহর থেকে আগত প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ এলাকার ভাষা সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেন।

ভাষা সৈনিক মীর আবুল হোসেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন মেছড়ায়। সেখানে তিনি মাইনর পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরে বিএল স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র। সিরাজগঞ্জ কলেজে অধ্যয়নের সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যস্ততার সাথে সময় কাটাতেন রবীন্দ্র, নজরুল জয়ন্তীসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্লাব নিয়ে।

সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষা দিয়ে মীর আবুল হোসেন কিছু দিনের জন্য গ্রামে আসেন। মেছড়া স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি তিনি ক্লাব, নাট্যমঞ্চ, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠায়ও অগ্রণী ভুমিলা পালন করেন। বিভিন্ন পাড়া থেকে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজে তার অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।  মীর আবুল হোসেন সহকারী শিক্ষক থেকে সহকারী হেডমাস্টার তারপরে হেডমাস্টারের দায়িত্ব পালন করে বিদায় নেন মেছড়া স্কুল থেকে।

১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। লেখলেখি তিনি আগেও করতেন। তমুদ্দন মজলিশের সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ এবং মাসিক ‘দ্যুতি’ পত্রিকায় লিখতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তার লেখা আরও গতিময়তা পায়। মাস্টার্স শেষে ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার লক্ষিবাজারে অবস্থিত শহিদ সোহরাওয়ার্দি কলেজে (তখন নাম ছিল কায়েদে আজম কলেজ) লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। কলেজে অধ্যাপনার আগে তিনি স্বল্পকাল দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেছেন। কলেজ জীবন থেকেই তার লেখা ছোট গল্প, প্রবন্ধ ও সমালোচনা ঢাকার বিভিন্ন পত্র পরিকায় মুদ্রিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের বার্ষিকী সম্পাদনা করেন। মাসিক মাহে নও, সওগাত, পূবালী ও বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য পাতায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তার ছোট গল্প সংকলন ‘বিপনীমন, উপন্যাস  ‘মহানদী-নিরবধি’ ‘ইবলিসের ঘরবাড়ী’ ‘নগরী নাগরী’ উল্লেখযোগ্য। এদেশের বিশিষ্ট লেখকদের আলোচনা সমৃদ্ধ তার ‘ নজরুল সাহিত্য’ একটি অনন্য গ্রন্থ। অধ্যাপনা জীবনের শেষভাগে উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অবসর জীবন যাপন করছিলেন। অবশেষে সিরাজগঞ্জের অন্যতম ভাষা সৈনিক এই কীর্তিমান মানুষটি গতকাল মঙ্গলবার ১২ নভেম্বর বিকেলে বনানীর নিজ বাসায় বার্ধক্য জনিত অসুস্থায় ইন্তেকাল করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button