আগামী ৭ জানুয়ারি সারাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ (সিরাজগঞ্জ সদর ও কামারখন্দ) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ০৫ জন। এরা হলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকে ড. জান্নাত আরা হেনরী, জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙল প্রতীকে আমিনুল ইসলাম ঝন্টু, জাকের পার্টির আবদুর রুবেল সরকার, বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির সাদাকাত হোসেন খান (বাবুল খান) ও কিংস পার্টিখ্যাত তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সোনালী আঁশ প্রতীকের রুবেল সরকার।
৭ জানুয়ারি সামনে মুখভরা হাসি নিয়ে দিনরাত নির্বাচনী প্রচারে, মিটিং, মিছিল ও দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন নৌকা প্রতীকের ড. জান্নাত আরা হেনরী। সদরের আসনে হেনরীর পাশে দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকরা ছাড়াও প্রচার করছেন মোতাহের হোসেন স্মৃতি যুব পরিষদ, সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী এই নারী নেত্রী। জয়ের আশায় প্রচারে এই আসনের অন্য ০৪ প্রার্থী। প্রত্যেকেই যার যার সাধ্যমতো নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্ত বাস্তবতা নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড়ে অনেকটাই দূরে জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি ও বাম ঘরণার ওয়ার্কার্স পার্টি।
জাতীয় সংসদে সিরাজগঞ্জ জেলার ৬টি আসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন সিরাজগঞ্জ সদরের একাংশ ও কামারখন্দ নিয়ে গঠিত সিরাজগঞ্জ-০২ আসন। অতীত রাজনৈতিক, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সদরের এই নির্বাচনী এলাকা। এ আসনের এশহরে পদার্পন করেছেন দেশ তথা ভারত বিখ্যাত রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ এর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্মভুমি এ আসনের পৌর এলাকায়। ৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগ।
স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত ১১টি নির্বাচনে জয়ের হিসেবে এ আসনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছে ০৪ বার, বিএনপি-০৫ ও জাতীয় পার্টি-০২ বার।
১৯৭৩ সালে এ আসেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রয়াত সৈয়দ হায়দার আলী জয়ী হন। ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত হন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি নেতা প্রফেসর এম এ মতিন। ১৯৯৬ সালের জুনে অনুিষ্ঠত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম।
১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙ্গল প্রতিকের ইকবাল হাসান টুকু, ১৯৯১ সালে বিএনপির ধানের শীষের মির্জা মোরাদুজ্জামান, ১৯৯৬ সালের (মধ্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে) ও ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপি নেতা ইকবাল মাহমুদ টুকু, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ইকবাল মাহমুদ টুকু নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষের প্রতীকে নির্বাচিত হন রুমানা আহমেদ। পরে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের নির্বাচিত হন অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না।
সিরাজগঞ্জ সদরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, জাতীয় পার্টি, সিপিবি, জাসদ (ইনু),বাসদ (খালেকুজ্জামান) দলের রাজনৈতিক কাঠামো আছে ও রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যায়। এর বাইরে অস্তিত্ব রয়েছে কয়েকটি ইসলামী পন্থী ইসলামী রাজনৈতিক দলের, জাকের পার্টির সাংগঠনিক অস্তিত্ব থাকলেও নির্বাচনের পূর্বে তেমন কোন রাজনৈতিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। সদরের শহরে এক সময়ে ওয়ার্কার্স পার্টির একটি ক্ষীণধারার অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে এদলের কোন রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চোখে পড়ে না।
২০২৪ সালের নির্বাচনে অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ জামায়াতে ইসলাম জোটগতভাবে এবং এছাড়াও বাম ঘরনার সিপিবি, বাসদ নির্বাচন বর্জন করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি ও কিংসপার্টি খ্যাত তৃণমুল বিএনপি এর মনোনীত প্রার্থীরা মনোনয়ন পত্র উত্তোলন করে। কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বিএনপি-জামায়াত সিপিবি, বাসদ এর কোন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র উত্তেলন করা থেকে বিরত থাকে। নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটভুক্ত আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধিরা প্রতিদ্বান্দ্বিতা করলেও জোটভুক্ত জাসদের ভুমিকা কারপক্ষে তা স্পষ্ট নয়।
এপর্যন্ত ৫ জন বৈধ প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় চলছে। শহর গ্রামের অলিগলিতে নৌকার পোষ্টারে ছেয়ে গেছে। নৌকার প্রতীকের বাইরে লাঙল প্রতীক, গোলাপ ফুল ও সোনালী আঁশ এর পোষ্টার ডিসেম্বর মাস থেকে দৃশ্যমান। দেরিতে হলেও হাতুড়ি মার্কার পোষ্টার এখন দৃশ্যমান। প্রার্থীরা নিজ নিজ সাধ্য ও সাংগঠনিক শক্তির জনবলের ভিত্তিতে গনসংযোগ, মিছিল, পথ সভা, মতবিনিময় করছে। তবে প্রচারে এগিয়ে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী জান্নাত আরা হেনরী। তিনি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সদর আসনে প্রতিদ্বদ্বিতা করে ২১২১ ভোটে বিএনপি প্রার্থীর নিকট পরাজিত হন। তবে ওই পরাজয় নিয়েও বাতাসে গুঞ্জন চলে অনেকদিন। পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন।
এবারের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে জান্নাত আরা হেনরীর নির্বাচনী পোষ্টার, ব্যানার উপজেলার সদর ও তৃণমুলের সড়ক, জনপদ, অলিগলিতে ছাপিয়ে গেছে। নৌকার প্রার্থী হাসিভরা মুখে, ফুরফুরা মেজাজে গনসংযোগ করছেন, পথসভা করছেন। যাচ্ছেন তৃণমুলে ভোটারদের কাছে। সেই সঙ্গে চলছে প্রচার মিছিল। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হেনরীর পক্ষে দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক ছাড়াও একাধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও জোটের নেতাকর্মীরাও প্রচারণা করছেন।
নির্বাচনে একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য সাদাকাত হোসেন খান বাবুল। বাবুল খানের রাজনৈতিক যুক্ততা বিশ^বিদ্যালয় অধ্যয়নকালিন শুরু। সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্ররাজনীতিতে বাবুল খান এর ছিল রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে শক্ত পদচারণা। পরবর্তীতে ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে স্থানীয় রাজনীতিতে তার পদচারণা ছিল না বললেই চলে। এছাড়া, স্থানীয় পর্যায়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সাংগঠনিক অবস্থাও দুর্বল। বলতে গেলে একক চেষ্টায় হাতুড়ি প্রতীকের প্রার্থী সাদাকাত হোসেন বাবুল খান ভোট যুদ্ধে লড়ছেন। নির্বাচনী প্রচারও চলছে ।
আরেক প্রার্থী জাতীয় পার্টি নেতা আমিনুল ইসলমি ঝন্টু। এক সময়ের ফুটবলার এবং ক্রীড়া সংগঠক আমিনুল ইসলাম। এশহরের পরিচিত মুখ। জাতীয় ছাত্র সমাজ, যুব সংহতির নেতৃত্বে পোক্ত হয়ে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয়। কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টির রাজনীতির পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিতেও রয়েছে তার দীর্ঘদিনের পদচারণা রয়েছেন। তার দল জাতীয় পাটি ক্ষমতা থাকা অবস্থায় সিরাজগঞ্জ-০২ আসনে ৮৬ ও ৮৮ সালে দুবার বিজয়ী হয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সামরিক জেনারেল এর হাতে গড়ে ওঠে দলটি ৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলের বিভক্তি, রাজনৈতিক ভুমিকায় নানা বিতর্কের জন্ম দেওয়া জাতীয় পার্টি এ এলাকায় অনেকটাই দুর্বল। ৯০ এর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরবর্তীতে ্েকান জাতীয় নির্বাচনে এ আসন কিংবা জেলায় কোন আসন থেকেই জয়ী হতে পারেনি জাতীয় পার্টি। এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী ঝন্টুর নির্বাচনী প্রচারনা চলছে। মিছিল, মাইকিং চলছে। পথসভা ও গণসংযোগ করছেন
এ নির্বাচনী এলাকায় জাকের পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো থাকলেও নির্বাচন পূর্ব পরিবেশে কোন রাজনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমান ছিলো না। প্রার্থীর পরিচিতিও তেমন নয়। অন্য এক প্রার্থী কিংসপার্টি খ্যাত তৃণমুল বিএনপি এ এলাকার কোন সাংগঠনিক কাঠামো নেই। নির্বাচনী যুদ্ধে প্রার্থীও নবাগত।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ওয়ার্কার্স পাটি, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, তৃণমূল বিএনপির মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে নৗকার প্রতীকের সঙ্গে কার্যত কোন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠছে না- এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় অনেকে।
অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি-জামায়াত, বাসদ,সিপিবি কোন প্রার্থী। এমনতর নির্বাচনী পরিবেশে আগামী ৭ জানুয়ারি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেষ হাসি হাসবে ড. জান্নাত আর হেনরী। অনেকেই ধারণা করছেন ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী জান্নাত আরা হেনরীর প্রাপ্ত ভোটের অনেক বেশি ভোটে এবারে সদরের নৌকার মাঝি হচ্ছেন জননেতা মোতাহার হোসেন তালুকদার এর পুত্র শামীম তালুকদার এর সহধর্মীনি ড. জান্নাত আরা হেনরী। নৌকা ফিরে যাবে আওয়ামী ঐতিহ্যের পরিবার আমৃত্যু আওয়ামী লীগার জননেতা প্রয়াত মোতাহার হোসেন এর ঘরে।
সবকিছু মিলিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ সদরে নৌকা প্রার্থীর হাসিভরা মুখে নির্বাচনী প্রচারণাই বলে দিচ্ছে-এ আসনে নৌকার বিজয়ী ঘোষণা সময়ের অপেক্ষামাত্র।