আজ সারাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে সিরাজগঞ্জের ৬টি আসনের ভোট যুদ্ধে লড়ছে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, জাকের পার্টি, সুপ্রিম পার্টি, বিএনএম ও অন্যান্য স্বতন্ত্র মিলে মোট ২৭ জন প্রার্থী। ইতিমধ্যে বেলকুচিতে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি ও রায়গঞ্জে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী মিছিল, মিটিং বন্ধ হওয়ার আগের সময় পর্যন্ত প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচার পরিচালনা করে। সবশেষে আজ জনতার রায়ে গোপন ব্যালটে জয় পরাজয় নির্ধারিত হবে। অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ সমমানা রাজনৈতিক দলসমূহ ও অংশ নেয়নি বামঘরানার সিপিবি ও বাসদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
এবারের নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ- ০১, আওয়ামী লীগের দুর্গ কাজীপুর। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ এর মধ্যজুনের নির্বাচন, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২০ এর উপনির্বাচনে এআসনে আওয়ামী লীগের নৌকা বিজয়ী হয়েছে। ১৯৭৯ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে দুবার এআসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয। এরমধ্যে ৮৮ সালের নির্বাচনে ওই আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি।
সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন এর প্রতিনিধি নির্বাচনী এলাকা ঘুরে নির্বাচনে তৃণমুলের ভোটারদের মতামত জানতে চেষ্টা করে। ভোটারদের মতামতে বোঝা যায়, এবারের নির্বাচনে এআসনে নিশ্চিত বিজয়ের পথে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতিকের প্রার্থী শহিদ এম. মনসুর আলীর নাতি ও সাবেক মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম পুত্র প্রকৌশলী তানভির শাকিল জয়। এ আসনে অন্যান্যদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাসদ এর সাইফুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির জহুরুল ইসলাম ও কিংসপার্টি খ্যাত বিএনএম এর সবুজ আলী। দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার কারনে ও প্রার্থীদের ব্যক্তিগত যোগ্যতায় নির্বাচন প্রচারকালিন সময়ে পর্যন্ত এতিনজন প্রার্থী ভোটারদের মনজয় করতে পারেনি। কার্যত কাজীপুরের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কার্যত কোন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে ওঠে নাই। সবকিছু মিলিয়ে বোঝা যায়, এ আসনে আজকের নির্বাচনে ভোটারের রায়ে নিশ্চিত বিজয়ের পথে নৌকার প্রার্থী তানভীর শাকিল জয়।
সিরাজগঞ্জ-০২ আসনের নৌকার প্রার্থী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নারী নেত্রী ড. জান্নাত আরা হেনরী। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালিন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রয়াত জননেতা মোতাহার হোসেন এর কনিষ্ঠ পুত্র শামীম তালুকদার এর সহধর্মিনী জান্নাত আরা হেনরী। তিনি নির্বাচনের তফশীল ঘোষণার আগে থেকেই তৃণমুলে পথসভা, উঠোন বৈঠক ও গণসংযোগের মধ্যদিয়ে নৌকার স্বপক্ষে ভোটারদের মানসজগতে তার ও নৌকার স্বপক্ষে একটি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলেন। তাছ্ড়াা ২০০৮ এর নির্বাচনে হেনরী বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে মাত্র ২১২১ ভোটে পরাজিত হয়।
এই আসনে গত ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা বিজয় অর্জন করে। সিরাজগঞ্জ-০২ আসনে অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম ঝন্টু, জাতীয় পার্টির প্রার্থী। নির্বাচনী এলাকায় এদলের সাংগঠনিক অবস্থা ক্ষয়িষ্ণু প্রায়। অন্যদিকে ওয়ার্কার্স পাটির প্রার্থী সাদাকাত হোসেন বাবুল। সাবেক এই ছাত্রনেতা স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে সুপরিচিত নয়। তদুপরি দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন কারো চোখে পড়েনি। এ আসনে আরেক প্রার্থী জাকের পার্টিও আব্দুর রুবেল সরকারও নির্বাচনে নবাগত। তার সংগঠন জাকের পার্টিও এই এলাকায় কোন রাজনৈতিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন দৃশ্যত দেখা যায়নি। এর বাইরে কিংস পার্টি খ্যাত বিএনএম সোহেল রানা নবাগত ও তার দর্লে সদরে কোন সাংগঠনিক কাঠামো আছে বলে কেউ বলতে পারেনি। সবমিলিয়ে সিরাজগঞ্জ-০২ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা ও নৌকার প্রার্থী হেনরীর ব্যক্তি ইমেজ নৌকার স্বপক্ষে জোরদার নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে অন্য প্রার্থীদের দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি ও ব্যক্তি ইমেজ নিয়ে নির্বাচনে তেমন কোন জোয়ার তুলতে পারেনি। সবমিলিয়ে আজকের নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-০২ আসনে ড. জান্নাত আরা হেনরী নির্ভাবনায় বড় বিজয়ের পথে এগিয়ে রয়েছেন বলে অনেকেই মতপ্রকাশ করেন।
সিরাজগঞ্জ-০৩: রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলা নিয়ে গঠিত এই নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের নৌকার মনোনীত প্রার্থী ডা. আব্দুল আজিজ। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনের আওয়ামী লীগের এমপি। এবারের নির্বাচনে এ আসনে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাকের পার্টি, মুক্তিপার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কৃষক লীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন সুইট। নির্বাচনে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ইতিমধ্যেই তার প্রার্থীতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া দিয়েছে।
এবারের নির্বাচনে এ আসনের নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত নির্বাচনী উত্তাপ ছড়ায় আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী বর্তমান এমপি ডা. আব্দুল আজিজ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন সুইট। নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা দলের ও দলের অঙ্গ সংগঠনের দুনেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছু বিভ্রান্ত। আবার অনেকেই দুপক্ষের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। অন্যদিকে নির্বাচনে রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলা এই ভৌগোলিক এলাকা নির্বাচনে জয়ে উল্লেখ করার মতো এক ধরনের ইউনিক প্রচারণার উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে। নির্বাচনের অন্য তিন প্রার্থীর একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী তার প্রার্থীতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে সমর্থন জানিয়েছে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন সুইটকে।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনের পর্যবেক্ষনের দেখা গেছে রায়গঞ্জ-তাড়াশ উপজেলায় নৌকার প্রার্থী ও প্রতিকের বিপক্ষে আওয়ামী লীগ এই দুই প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে পুরো নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের উত্তাপ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে অন্য তিন প্রার্থীর প্রচারণা ছিল টিমেতালে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে নির্বাচনের নৌীকার বিপক্ষে ঈগল জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জয় পরাজয় ভোটারের ভোট প্রদান শেষে ফলাফল ঘোষণার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যায় না বিজয়নের মালা কার গলায় ভোটাররা পরিয়ে দেবে। আজ দিনশেষে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরই এই বিতর্কের যবনিকার অবসান হবে বলে ভোটারদেও মতামতে বোঝা যায়।
সিরাজগঞ্জ-০৪: এ আসনে টানা দুবারের নৌকা প্রতিকের এমপি তানভীর ইমাম এবারে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন। নৌকা প্রতিক পান সাবেক এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম শফি। এখানে অন্য প্রার্থী জাসদ এর মশাল প্রতিক নিয়ে মোস্তফা কামাল বকুল ও জাতীয় পার্টিও তাতী নেতা হিল্টন প্রামাণিক নির্বাচন করছেন। নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে অন্য দুই প্রার্থী তাদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার ঢেউ তুলতে পারেনি। একে তো আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সাংগঠনিক অবস্থা তদুপরি জাসদ ও জাতীয় পাটির দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা, প্রার্থীর পরিচিতি ও রাজনীতিতে সক্রিয়তা সবকিছু মিলিয়ে এবারের নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে কোন শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি দুপ্রার্থী। এআসনে নৌকার প্রার্থী বীরমুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম শফি নির্বাচনী যুদ্ধে অনেকটাই নির্ভাবানায় বিজয়ের পথে এগিয়ে আছেন।
সিরাজগঞ্জ-০৫: নৌকার মনোনীত প্রার্থী শিল্পপতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমিন মন্ডল এর বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইরের অবস্থা তৈরি করেছে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, ২০০৮ এর নির্বাচনে নৌকার প্রতীক নিয়ে বিজয়ী এবারের দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল লতিফ বিশ^াস। এ আসনে উভয় প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় মিছিল, সভাসমাবেশে ব্যাপক লোক সমাগম ঘটে। নির্বাচনী প্রচারণায় উভয় প্রার্থীই ভোটারদের নিজ নিজ যোগ্যতার বিবরণ তুলে ধরে অতীতের কর্ম এবং আগামীর প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে তাদের বক্তৃতায়। প্রচারণার শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত দারুন উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে পুরো নির্বাচনী এলাকায়। এআসনে অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল আল মামুন কাঁচি প্রতিক নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালনা করছেন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হওয়ার আগ মুহুর্তে গামছা প্রতিকের প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে জাতীয় পার্টির পক্ষে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা ও প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব নির্বাচনে ভোটারদের মনোভাব তার স্বপক্ষে টানতে পারেনি।
এলাকা ঘুরে দেখা জানা যায়, তাত সমৃদ্ধ আর নদী ভাঙন কবলিত এই নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা উভয় প্রার্থী নিজ নিজ জয়ের বিষয় শতভাগ আশাবাদী। তবে সব জল্পনা কল্পনার অবসান হতে যাচ্ছে আজদিনের ভোটাদের রায়ে। এআসনে কে জয়ী হতে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভোটশেষে নির্বাচনী ফলাফলের ওপর।
সিরাজগঞ্জ-০৬: শাহজাদপুর নির্বাচনী এলাকা। তাত সমৃদ্ধ এই নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এ আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী সাবেক এমপি, উপজেলা আওয়ামী সভাপতি চয়ন ইসলাম ও স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরু এর প্রচারণা পুরো নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনী উত্তাপ ছড়ায়। নির্বাচনী এলাকায় অন্য ৪ জন প্রার্থী থাকলেও প্রধানত নির্বাচন কেন্দ্রভুত নৌকার মনোনীত সাবেক এমপি চয়ন ইসলাম ও সাবেক মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী হালিমুল হক মিরু এর সঙ্গে। শেষ হাসি কার মুখে তা বোঝা যাবে আজ ভোটের শেষে ভোটের ফলাফলে। এ নির্বাচনে সারা দেশে বিএনপিসহ জামাত নির্বাচন বর্জন করেছ্।ে স্থানীয় পর্যায়েও ওই সব দল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুসরন কওে নির্বাচন বর্জন করেছে। এ অবস্থা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদেও অবস্থা বিশ্লেষন করলে সব মিলিয়ে সিরাজগঞ্জ-০১, ০২ ও ০৩ আসনের আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীগন বিজয়ে অনেকটাই নির্ভাবনায় রয়েছে। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জ-০৩, সিরাজগঞ্জ-০৫ ও সিরাজগঞ্জ-০৬ আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থীগন নিজ দলেরই স্বতন্ত্র পরিচয়ে ঈগল প্রতিকের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি । তবে আজ দিনশেষে এ দৃশ্যের যবনিকা ঘটবে যখন ভোটের ফলাফল ঘোষিত হবে।