সদরসাহিত্যসিরাজগঞ্জ

হয়তো ফিরে আসবে

স্থির যমুনার মত জেনি আজ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূর দিগন্ত যেখানে শেষ হয়েছে রক্তিম ছায়ায়। সাদা মেঘ ভেসে চলেছে আপনমনে । পাখিরা ঝাঁক বেঁধে নিরে ফিরছে। জেলেরা জাল তুলে রওনা হচ্ছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। মাঝিরা নৌকা বাঁধছে নদীর তীরে।

সব মিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে চারিদিকে।

সেসময় পিয়াস এসে জেনির পাশে বসলো। জেনি বাসা থেকে বের হবার আগে পিয়াসকে কল করেছিলো। পিয়াস জেনির সবচেয়ে কাছের একজন বন্ধু কিংবা ভাইও বলা চলে। বোঝা যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি করে আস্তে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চ কন্ঠে পিয়াস বলে উঠলো,

“হঠাৎ এতো জরুরি তলবে এখানে?

জেনি একবারও পাশ ফিরে না তাকিয়ে উত্তর দিলো,

“শেষ দেখা করার জন্য এই জায়গাটাই মনে ধরলো ।তাই এখানে ডাকলাম ।”

পিয়াস কিছুটা তাচ্ছিল্য এবং একটু বিরক্ত সরে বললো

“এসব কি বলছিস রে ভাই ? একটু ঝেড়ে কাশতো।”

” কাল আমার অপারেশন ।”

পিয়াস এবার খুব অবাক হয়ে নড়েচড়ে বসল-

“মানে, কিসের অপারেশন ?”

জেনি তার দৃষ্টি স্থির রেখে একনাগাড়ে বলতে শুরু করলো,

” ‘রিটেনশন এক্সইউডেশন’ -সেরিব্রামের ম্যাটার । জন্মগত সমস্যা। এ ব্যাপারে জেনেছি কাল রাত্রে। রিটেনশন এক্সইউডেশনের সমস্যা থাকলে ২৫ বছর বয়সে অপারেশন করতে হয় । অপারেশনের পর ভাগ্য ভালো থাকলে আমি বেঁচে থাকবো না হয়..। তবে বেঁচে থাকলেও স্মৃতি মুছে যাবে । কাল সকালে হসপিটাল ভর্তি হবো । অপারেশনের পর ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তো এক নতুন জেনির জন্ম নেবে। কোনো কিছুই তো মনে থাকবে না। এতো স্মৃতি ,এতো অনুভূতি সব বিলীন হয়ে যাবে। তোকে না , বাবা-মা কাউকেই মনে থাকবে না। তাই ভালোলাগার জিনিসগুলো শেষবারের মতো দেখছি । তখন এগুলো আর ভালো না লাগতে পারে। আবার বেঁচে নাও থাকতে পারি ।তবে একটা জিনিস ভেবে খুব ভালো লাগছে যে বেঁচে থাকলে অতীতের তিক্ত স্মৃতিগুলো মনে থাকবে না । এটা বেশ ভালো ।”

জেনি এই পর্যায়ে পিয়াসের দিকে তাকায়। সে অবাক হয়ে নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে ।জেনি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে উঠতে উঠতে বললো,

“চল , কিছু ক্ষণ রিকশা নিয়ে ঘুরে তারপর বাড়ি যাবো।”

পিয়াস কিছু না বলে উঠে একটি রিক্সা ঠিক করলো।

পড়ন্ত বিকেলে শহরের পথে রিকশা নিয়ে কিছু ক্ষণ ঘুরলো তারা দুজন। এরপর জেনি বাড়ির দিকে যাত্রা করে। বাসায় ফিরে জেনির বাসার সবাই চুপচাপ। জেনি কে দেখে জেনির মা রেগে গেলেন।

-“তোকে না বলছি , বাহিরে না যেতে । কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলি !”

জেনি নিচু গলায় বললো-“বাবার অনুমতিতে।”

কথাটি বলে সে নিজের রুমে চলে যায় । তার মা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলো। পিয়াস জেনির বাবার পাশে গিয়ে বসলো।পুরো বাড়িতে এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

জেনি তার রুমে গিয়ে ফিকে হয়ে যাওয়া কালো ডায়েরিটি বের করে পুরোনো লেখাগুলো শেষ বারের মত পড়তে শুরু করলো । তার অতীতের প্রতিটি কষ্টের ঘটনাগুলো পড়া শুরু করলো । এক পর্যায়ে জেনি আক্ষেপের সুরে বলে উঠলো -“ইস!যদি দুঃখের স্মৃতিগুলো না লিখে সুখের স্মৃতিগুলো লিখে রাখতাম!

জেনি তার শত মিথ্যা মায়ায় জড়ানো হাজারো দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত ডায়েরি গুলো নিয়ে ছাদে চলে যায় ।

ছাদটা বেশ বড় । বড় ছাদটির মাঝখানে সবগুলো ডায়েরি পাতাগুলো যত্ন করে সময় নিয়ে ছিঁড়ল । অতঃপর তার ওপর কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। স্থির দৃষ্টিতে জেনির দেখতে থাকলো তার জীবনে ঘটে যাওয়া হাজারো অব্যক্ত ঘটনার বিনাশ ।২৪ ঘন্টা পর তার স্মৃতি থেকেও হয়তো মুছে যাবে হয়তো ঘটবে তার জীবনের বিনাশ। দেখতে দেখতে একপর্যায়ে ডায়েরির পাতাগুলো ছাই এ পরিনত হয়।

পরদিন খুব ভোরবেলা জেনি তার বারান্দার কার্নিষ উপর বসে কফি খেতে খেতে শেষ সূর্যোদয় দেখে । যদিও শেষ নাকি শুরু তা জেনি জানে না । চারদিকে পাখির কিচিরমিচির ডাক। বসন্তে আগমনের নতুন আভাস। হঠাৎ তার বুকে এক তীব্র ব্যথা অনুভব করে ষ কারন তার অজানা । বাড়ির সবাই ভোর থেকেই নানা কাজে ব্যস্ত জেনির জন্য। জেনিও একপর্যায়ে গোসল করে হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় ।

সকাল ১০.৩০ মিনিট

জেনিকে নিয়ে তার বাবা-মা ডক্টরের সামনে বসে আছে । সকালে জেনির একটি টেস্ট করানো হয় ।টেস্টের রিপোর্ট এখন ডক্টরের হাতে। ডক্টর কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রিপোর্ট দেখে একপর্যায়ে জেনিকে এবং তার মাকে বাহিরে যেতে বলে ।

-“মিস্টার আহমেদ , আপনাকে শেষ বারের মতো বলছি আমরা আপনার মেয়ের অপারেশন করবো কিন্তু তার বাঁচার আশংকা এক শতাংশও নেই ।”

-“কোনো ভাবেই কি আমার মেয়েটাকে বাঁচানো যাবে না ডক্টর । যতটাকা লাগে আমি খরচ কিন্তু দয়া করে আমার মেয়েটাকে বাঁচান । প্রয়োজন হলে বলুন আমি আমার মেয়েকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাবো ।”

কথাটি শেষ করেই শক্ত হৃদয়ের মানুষটার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়লো । কিন্তু ডক্টরের কাছে উত্তর দেওয়ার মত কিছুই নেই ।

১২ টার সময় জেনি কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় । জেনি তার শেষ অবস্থা সম্পর্কে জানে না । যাওয়ার আগে তার মায়ের সাথে আর সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সাথে শেষবারের মতো কথা বলে । জেনির বাবা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । জেনি তার বাবার কাছে যায়-

“বাবা , নিজের খেয়াল রেখো । তুমি কিন্তু একদম আমাকে নিয়ে চিন্তা করবে না । বুঝেছো ?”

জেনির কথা শেষ হতে না হতেই তার বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে । অনেক কষ্টে তারা দূজনি নিজের অশ্রু ধরে রাখে । মেয়ের চিরবিদায় কে সহিতে পারে!

১২.৩০ মিনিটে জেনির অপারেশন শুরু হয়। হয়তো কিছুক্ষণ পরেই চিরনিদ্রা যাপন করবে । ঘড়ির কাঁটা যেন থমকে আছে। জেনির মা জায়নামাজে মেয়ের জন্য ইবাদতে মগ্ন । পিয়াস তাকিয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতিল দিকে ।

৩.৩৫ মিনিট-

দীর্ঘ প্রায় চার ঘন্টা পর নিভে গেল লালবাতি টি । অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলো । ডক্টরের চাহনি দেখে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো জেনির বাবার।

হঠাৎ একরাশ হাসি ফুটে উঠল ডক্টরের চোখে মুখে।

-“সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় আমার আপনার মেয়েকে বাঁচাতে পেরেছি । ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরবে বলে আশা করছি।”

-“ধন্যবাদ ডক্টর । আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।”

-“ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তাকে দিন । তিনি আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছেন।”

৪৮ ঘন্টার মধ্যেই জেনির জ্ঞান ফেরে। সে জীবিত আছে এবং তার স্মৃতিও ঠিক থাকে । হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই আবার সুন্দর জীবন শুরু করে জেনি ।

“হয়তো বাস্তবে জেনি মারা যেত। ক্ষুদ্র গল্পে ক্ষুদ্র চরিত্রের জেনিকে গল্পকার বাঁচিয়ে দিয়েছে ।”

সমাপ্ত [বি:দ্র: উল্লেখিত “রিটেনশন এক্সইউডেশন” রোগটি আমার কল্পনা মাত্র ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button