বীরমুক্তিযোদ্ধা শাহাদত হোসেন ফিরোজী:
বিশাল জলরাশি নিয়ে বয়ে চলা যমুনার ঘূর্ণি স্রোতে ধসে গেছে নদীর তীররক্ষা। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে যমুনার প্রবল স্রোতে সিরাজগঞ্জে শাহজাদপুরে ডান তীররক্ষা বাধে নেমেছে ধস। ফলে দুঃস্বপ্নের মত তলিয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বিনোটিয়া গ্রামের বিধবা স্বর বানু আর দুলু খাতুনসহ আরও অনেকের বসতভিটা।
স্বরবানুর ছেলে ও মেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অন্যত্র বিয়ে করেননি আর। স্বামীর ভিটা আঁকড়ে ধরে অন্যের বাড়িতে কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। কঠোর পরিশ্রম আর নিজের আত্মবিশ্বাস দিয়ে জীবন যুদ্ধে অপরাজেয় এই মা, দুমেয়ে ও ছেলেকে বিয়েও দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে ছেলের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছেলেটা অন্যত্র বিয়ে করে জীবিকার তাগিদে চলে গেছেন শহরে।
স্বর বানুুর যেন দুঃখের দিন শেষ হওয়ার নয়। ছেলেটা অন্যত্র বিয়ে করার পর স্বর বানুর উপরই নতুন করে যুক্ত হয় ৪ বছর বয়সী নাতি। এরপর হঠাৎ করে বাড়িটাও যমুনা গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে খোলা আকাশের নীচে ভাঙা টিন মাথার উপর দিয়েই কোনরকম আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি বাধের উপর। এদিকে দুলু খাতুনেরও দুনিয়ায় কেউ নেই। একমাত্র সম্ভল বসতভিটাও নদী গর্ভে চলে যাওয়ার পর দুচোখে কেবল যমুনার স্রোতের মত টলটলে অশরু আর একরাশ হতাশার কুয়াশা ছাড়া কিছু নেই।
অপরদিকে উপজেলার সোনাতুনি ইউনিয়নের হাতকোড়া গ্রামের ৫৪ বছর বয়সী ইসমাইল হোসেন একদশক আগে ভিটেমাটি নদীতে হারিয়ে বাড়ি করেছিলেন যমুনার কোল ঘেষে। ভেবেছিলেন আর ভাঙ্গনের কবলে পরতে হবে না । কিন্তু তার দুঃখের দিন শেষ হলোনা। একরাশ হতাশার মধ্যে সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুড়মার করে দিয়েছে যমুনা তীররক্ষা বাঁধে ধস নেমে । এভাবেই অত্র এলাকার রূপচাঁদ মোল্লা, মো. এরশাদ মোল্লা, মজনু মোল্লা, আলী মোল্লা, আমদ আলী মোল্লা, বাতেন মোল্লা সহ অর্ধশতাধিক মানুষ কোনক্রমে ঘরের চাল খুলে নিয়ে খুজে ফিরছেন আশ্রয়।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ১১৫ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত যমুনা নদীর তীর রক্ষা বাঁধে নতুন করে ধস শুরু হয় সপ্তাহ খানেক আগে। তীররক্ষা বাঁধের সিসি ব্লক ধসে ইতোমধ্যেই মসজিদসহ অন্তত ২৫ টি বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক দিনেই যমুনার ঘূর্ণি স্রোতে ধসে যায় যমুনার তীর রক্ষা বাঁধ। উপজেলার গালা ইউনিয়নের বেনোটিয়া পয়েন্টে কয়েকটি স্থানে এ ধস শুরু হয়।
নদী তীরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন ও মধুমালা, বিধবা দুলু খাতুন, বিধবা স্বর বানু, রূপচাঁদ মোল্লা, মো. এরশাদ মোল্লা, মজনু মোল্লা, আলী মোল্লা, আমদ আলী মোল্লা, বাতেন মোল্লা অভিযোগ করে বলেন, বর্ষার শুরুতেই আমরা নদীর এই অংশের আশংকাজনক অবস্থার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবগত করি। কিন্তু সময়মত তারা ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই ধস শুরু হয়। কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই এই এলাকার ঐতিহ্যবাহী শিমুলকান্দি জামে মসজিদ নদী গর্ভে চলে যায়। তারপর একে একে অন্তত ২৫ টি ঘরবাড়ি যমুনার গর্ভে চলে যায়। ভাঙন অব্যাহত থাকায় এলাবাসী আতঙ্কিত হয়ে পরেছে।
এবিষয়ে গালা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেন জানান, ‘বাঁধ নির্মাণের সময় তীররক্ষা বাঁধের একেবারে নিকট থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন এবং অবৈধ বালু ব্যাবসায়ীরা অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করেছে। একারনে সিসি ব্লকের নিচ থেকে বালু ও জিও ব্যাগ সরে গিয়ে বাঁধের বিভিন্ন অংশে ধসের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনেক আগেই লিখিত জানালেও তারা কার্যকরি কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
এ বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত ইঞ্জিনিয়ার শাহীন কামাল জানান, ভাঙন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আমরা জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছি। আশা করি আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারব। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যসহকারি মো. নুরুল ইসলাম জানান, নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় হঠাৎ করেই ধস শুরু হয়েছে । তবে আমরা ভাঙন ঠেকাতে সাথে সাথেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমাকে জানানোর পর সাথে সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। ইতোমধ্যেই তারা জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ওই এলাকার ৬০০ মিটারে জিও বস্তা ফেলা হচ্ছে। নতুন প্রকল্পের কাজের টেন্ডার হয়েছে যা বাস্তবায়িত হলে এ এলাকা ভাঙ্গন মুক্ত হবে।
মন্তব্য করুন